ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ০৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ফিচার

সাসানীয় শিল্পের অনন্য নিদর্শন

ইরানে মিলল বিশ্বের সবচেয়ে ছোট প্রাচীন শিলালিপি

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:০৩, আগস্ট ২৮, ২০২৫
ইরানে মিলল বিশ্বের সবচেয়ে ছোট প্রাচীন শিলালিপি খোদাইয়ের সূক্ষ্ম শিল্প: ০.৫ মিলিমিটার যন্ত্রে লেখা হলো ইতিহাস

ইরানের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট প্রাচীন শিলালিপি আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. আবুল হাসান নাজাফজাদে আতাবাকি জানিয়েছেন, শিলালিপিটি সাসানীয় সাম্রাজ্যের শেষ যুগের অর্থাৎ প্রায় ১,৬০০ বছর আগের।

মাত্র ৪ বাই ৭ সেন্টিমিটার আকারের অর্থাৎ একটি দিয়াশলাই বাক্সের সমান, এই শিলালিপি ফার্স প্রদেশের মারভদাশ্ত ও ইক্লিদ জেলার সীমান্তবর্তী একটি খাড়া পাহাড়ে খোদাই করা হয়েছিল। এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল মাত্র ০.৫ মিলিমিটার প্রস্থের সূক্ষ্ম অগ্রভাগ বিশিষ্ট একটি যন্ত্র।

ড. আতাবাকি বলেন, “এই অসাধারণ আবিষ্কার সাসানীয় যুগের খাঁটি ইরানি শিল্পকর্মের এক মহৎ নিদর্শন। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এমন মূল্যবান সন্ধান জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে এবং ভবিষ্যতে পর্যটন আকর্ষণেরও উৎস হতে পারে। ”


ড. আবুল হাসান নাজাফজাদে আতাবাকি

ড. আবুল হাসান নাজাফজাদে আতাবাকি কেবল একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ নন, লেখক হিসেবেও তিনি পরিচিত এবং গবেষণা কার্যক্রমে সক্রিয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি ফার্স প্রদেশে সাসানীয় যুগের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপি আবিষ্কার করেছেন, যা ইরানের প্রাচীন ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

তাঁর নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে ইরানি ইতিহাসবিদ নাজমে ইব্রাহিমি জানান, শিলালিপিটি পাহলভি ও মধ্য পারস্য লিপিতে মোট ৯ লাইনে লেখা। তবে এর প্রথম দুটি লাইন পাথরের স্তরে ঢাকা পড়ে আছে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, সম্ভবত শিলালিপিটি প্রাচীন ইস্তাখর শহরের কোনো বাসিন্দা রচনা করেছিলেন এবং এতে সাসানীয় যুগের স্বভাবসিদ্ধ ধর্মীয় বক্তব্য ছিল।

শিলালিপির মূল বিষয়বস্তু হলো কর্ফা (সৎকর্ম/পুণ্য), উইনাহ (পাপ) এবং ‘মহান কর্ফা’-এর বৈশিষ্ট্য। সাসানীয় ধর্মীয় সংস্কৃতিতে কর্ফা বা সৎকর্ম ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা আত্মার মুক্তি ও পরকালের পুরস্কারের সঙ্গে সম্পর্কিত।

ইব্রাহিমি জানান, মৃত্যুর পর আত্মা অমর এবং চূড়ান্ত বিচারের মুখোমুখি হবে—এই বিশ্বাস সাসানীয় ধর্মীয় জীবন ও সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁদের মতে, সৎকর্মশীল ও ধার্মিক মানুষের আত্মা জান্নাতে পুরস্কৃত হয় আর পাপীদের আত্মা দোজখে গিয়ে শাস্তি ভোগ করে।

বৃহত্তর ধর্মীয় ঐতিহ্যের অংশ

ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এই ক্ষুদ্র শিলালিপিটি আসলে একটি বৃহত্তর ধর্মীয়-দার্শনিক ধারার অংশ। সাসানীয় যুগের বিখ্যাত মোবেদ কর্তির শিলালিপি ছাড়াও বহু জরথুষ্ট্রীয় গ্রন্থে একই ধরনের ধারণা পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে: বন্দেহেশ, ভেন্দিদাদ, আরদা বিরাফ নামা, মিনুই খিরদ, দেনকার্দ এবং আরও বহু গ্রন্থ, যেখানে পুণ্য ও পাপের শাস্তি এবং আত্মার গন্তব্য নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

ইব্রাহিমি জানান, ড. আতাবাকি ইতোমধ্যেই শিলালিপির গবেষণা ও অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন এবং শিগগিরই এটি আন্তর্জাতিক একাডেমিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হবে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

দক্ষিণ ইরানের পার্সেপোলিসের কাছে অবস্থিত প্রাচীন ইস্তাখর নগরী একসময় সাসানীয় রাজাদের আসন ছিল। সেখানে প্রাসাদ, প্রতিরক্ষা কাঠামো এবং মন্দির নির্মিত হয়েছিল।

নগরীটির রাজনৈতিক গুরুত্ব শুরু হয় খ্রিষ্টাব্দ ২২৪ সালে, যখন আরদাশির প্রথম পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের রাজা আরতাবানুস চতুর্থকে পরাজিত করে সাসানীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

সাসানীয় যুগে ইরানি শিল্প ও স্থাপত্য তাদের শীর্ষে পৌঁছেছিল, যার নিদর্শন পাওয়া যায় বিশাপুর, নকশে-ই রাজাব এবং নকশে-ই রোস্তমে নির্মিত প্রাসাদ ও দেয়ালচিত্রে।  

প্রত্নতত্ত্ব ও পর্যটনের সম্ভাবনা

বিশ্বের সবচেয়ে ছোট এই শিলালিপি শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এক অমূল্য আবিষ্কার। এটি প্রমাণ করে, সাসানীয় যুগের মানুষরা কেবল স্থাপত্য ও শিল্পেই নয়, বরং সূক্ষ্ম খোদাই প্রযুক্তি এবং জটিল ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা প্রকাশেও ছিল অসাধারণ দক্ষ।

ড. আতাবাকি মনে করেন, শিলালিপির ক্ষুদ্র আকার ও সূক্ষ্ম খোদাই শুধু শিল্পকৌশলের নিদর্শনই নয়, বরং প্রাচীন ইরানিদের ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারার প্রতিফলন। এর আবিষ্কার একদিকে জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক, অন্যদিকে ইরানের সাংস্কৃতিক পর্যটনের জন্য নতুন এক আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।