যশোর: রোগমুক্তির জন্য ১১টি বিষধর সাপের বাচ্চা লালন পালন শুরু করেছেন যশোর সদর উপজেলার দোগাছিয়া গ্রামের আতিয়ার গাজীর মেয়ে পারুল বেগম (২৫)। এ সাপ পালনের দাওয়াই স্বপ্নে পেয়েছেন- এমনই দাবি তার।
গত ১০দিন ধরে পারুলের এ সাপের দাওয়াই দেখতে এবং স্বপ্নের গল্প শুনতে তার বাড়িতে ভিড় করছেন শতশত মানুষ। কেউ এটিকে বিশ্বাস করছেন, কেউবা তার এ স্বপ্নকে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউবা আবার দেখছেন সন্দেহের চোখে।
কেউ জানাচ্ছেন, প্রতারণার কবিরাজী ব্যবসা ফাঁদতে এমনই গল্প সাজিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন পারুল বেগম। যদিও পারুল বেগমের দাবি তার নিজের রোগ চিকিৎসার জন্যই এ দাওয়াই।
স্বপ্ন ও সাপ পালনের ঘটনার সূত্রপাত বর্ণনা করতে গিয়ে পারুল বেগম বাংলানিউজকে জানান, মাগুরা শহরের একটি বাড়িতে তিনি গৃহকর্মীর কাজ করতেন। ১৫ দিন আগে তিনি সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি দোগাছিয়ায় আসেন।
বাড়ি আসার পর একদিন রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন, তাকে সাপে কামড় মেরেছে। এ সময় চিৎকার দিয়ে তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠলে বাড়ির সবাই তার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু তখন কোথাও সাপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
এরপর তিনি আবারও ঘুমিয়ে পড়লে স্বপ্নে তার রোগমুক্তির জন্য মাগুরার একটি বটতলায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পারুল বেগম মাগুরায় তার মালিকের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে গিয়ে ফের তিনি স্বপ্নে ওই নির্দিষ্ট বটতলায় যাওয়ার নির্দেশনা পান।
১০ দিন আগে ভোরে তিনি ওই বটতলায় যাওয়ার পর সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বয়োবৃদ্ধ তাকে একটি মাটির হাড়ি দিয়ে বলেন, Òএটি বাড়ি নিয়ে যা। Ó
কিন্তু হাড়ির মধ্যে সাপ দেখতে পেয়ে পারুল বেগম তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। তখন ওই বৃদ্ধ তাকে বলেন, “এগুলো নিয়ে লালন-পালন করলে তোর রোগমুক্তি মিলবে, আর না নিলে ভয়ানক ক্ষতি হবে। ”
একপর্যায়ে রাজি হলে ওই বৃদ্ধ তাকে মাটির হাড়িতে ১১টি বিষধর সাপের বাচ্চা দিয়ে বলেন, “দুমাস এগুলোকে লালন-পালন করে ফিরিয়ে দিয়ে যাবি। এরপর তোকে দু’টি বড় সাপ দেওয়া হবে। ”
তিনি বলেন, “সাবধান! এ সাপের ক্ষতি হলে তোরও ক্ষতি হবে। ”
এরপর পারুল বেগম সাপগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন এবং সেগুলোর লালন-পালন শুরু করেন।
যে রোগমুক্তির জন্য এই সাপ পালন- তার ইতিহাস বলতে গিয়ে পারুল বেগম বাংলানিউজকে জানান, ১০/১২ বছর আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শরীরে টিউমার জাতীয় বস্তুর অস্তিত্ব দেখা দেয়। গায়ের চামড়া ফুলে শক্ত হয়ে বিভিন্নস্থানে দড়ির মতো আকার ধারণ করে। একই সঙ্গে শরীরে জ্বালাপোড়াও দেখা দেয়।
এ নিয়ে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। তখন চিকিৎসকরা জানায়, তার লিভারে সমস্যাসহ নানা জটিল রোগ হয়েছে। এরপর বছরের পর বছর তিনি ওষুধ খেয়েছেন কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শরীরের ওই অস্বাভাবিকতা ও জ্বালাপোড়া রয়েই গেছে।
এরই মধ্যে ৫ বছর আগে তার বিয়ে হয় পাশের একটি গ্রামে। কিন্তু অসুস্থতার কারণে এক বছরের মধ্যেই তার বিয়েটা ভেঙে যায়।
এরপর পারুল বেগম বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। সর্বশেষ তিনি মাগুরা শহরের একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করছেন।
পারুল বেগমের মা আয়শা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, পারুল সাপ বাড়ি নিয়ে আসার পর তিনি অনেক বকাঝকা করেছেন এবং এগুলো সরিয়ে ফেলতে বলেছেন। কিন্তু পারুল রাজি না হয়ে জানিয়েছে, এগুলোকে সে সন্তানের মমতায় লালন-পালন করবে।
এদিকে, পারুল বেগমের ১১টি সাপের কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে প্রতিদিনই কয়েকশ মানুষ ভিড় করছেন তার বাড়িতে। এ কারণে বাড়ির উঠানে বাঁশের চটা দিয়ে ঘিরে একটি প্রদর্শনী স্থান তৈরি করা হয়েছে।
দিনের অধিকাংশ সময় পারুল বেগম তার সাপের বাচ্চাগুলো নিয়ে সেখানে দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করছেন। কখনও আদর করে চুমু খাচ্ছেন, কখনও খেলা করছেন। তবে সাপ নিয়ে কোনো কবিরাজী না করলেও সাপ দেখিয়ে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। দর্শনার্থীরাও সাপের খাবারের জন্য তাকে টাকা দিচ্ছেন।
পারুল বেগম আরও জানান, স্বপ্নে রোগমুক্তির জন্য তাকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তিনি তাই পালন করছেন। এর বেশি কিছু নয়। তিনি ওঝা বা কবিরাজ নন। তাই সাপ দেখিয়ে তিনি কাউকে চিকিৎসা বা ঝাঁড় ফুঁক দিচ্ছেন না। কারণ স্বপ্নে তিনি এ ধরনের কোনো নির্দেশ পাননি। তবে পরবর্তীতে স্বপ্নে এমন নির্দেশনা পেলে তিনি করতে পারেন। এখন যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি সাপ পালন করছেন, তার সেই রোগ ধীরে ধীরে উপশম হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
প্রতিবেশী ইমদাদুল হক বাংলানিউজকে জানান, পারুলের এ সাপ দেখতে প্রতিদিন শতশত মানুষ তার বাড়িতে ভিড় করছেন। কিন্তু পারুল সাপ নিয়ে কোনো ধরনের কবিরাজী বা বাণিজ্যের চেষ্টা করছে না। এ কারণে এর মধ্যে কোনো প্রতারণা থাকার আশঙ্কা কম বলে তিনি মনে করেন।
পাশের গ্রাম ইসলামপুরের আব্দুল হালিম জানান, পারুল ওই সাপগুলো নিয়ে খেলা করছে, গালে নিচ্ছে অথচ সাপ তাকে কামড়াচ্ছে না। এটি একটি রহস্য। তবে স্বপ্নে পাওয়া এমন নির্দেশ মেনে রোগমুক্তি হয় কিনা তা নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে।
এ বিষয়ে চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তার বাংলানিউজকে জানান, স্বপ্ন দেখে সাপ লালন-পালনের ঘটনা তিনি শুনেছেন। খবর পেয়ে তিনি কয়েকজন মেম্বরকেও বিষয়টির খোঁজ খবর নিতে পাঠিয়েছিলেন। তারা জানিয়েছে, ওই নারী কবিরাজী না করলেও সাপের খাবারের জন্য টাকা নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১২
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী ও ওবায়দুল্লাহ সনি, নিউজরুম এডিটর