পাবনা : কালো আর ধুসরে মেশানো মাঝারী আকৃতির পায়রা। চোখটা লালচে, ঠোঁটের উপরিভাগ আর লেজের বেশ খানিকটা সাদা।
অরিজিনাল হল্যান্ড রিং পরানো এক জোড়া পমেলিয়ান পায়রার দাম এক লাখ ২০ হাজার টাকা! আঁতকে ওঠার মতোই।
শুধু পমেলিয়ান নয়। এক জোড়া ইয়োলো হেনা ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ, ব্লু হেনা জোড়া প্রতি দেড় লাখ, প্রমারিয়ান পোর্টার, ম্যাগপাই পোর্টার ব্লু, ইয়োলো স্ট্রেচার, জার্মান কুপারসহ আরো অনেক ধরনের পায়রা, যাদের জোড়া প্রতি দাম ১ লাখ টাকা বা তারও বেশি।
আর সৌখিন এসব পায়রা পাবনার বহু বেকার যুবককে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি খ্যাতি এনে দিয়েছে অল্পদিনেই। দিনে দিনে সৌখিন পায়রার খামার পাবনায় শিল্পে রূপ নিয়েছে। শখের বশে পায়রা পালন এখন তাদের সুখের পায়রায় পরিণত হয়েছে।
পাবনায় সৌখিন পায়রার খামার কে প্রথম গড়েছেন তা সঠিক জানা না গেলেও খামারীরা মনে করেন শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লার মঞ্জিল হোসেন সৌখিন কবুতর খামারের পথ প্রদর্শক।
আলাপকালে মঞ্জিল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে পায়রা পোষা আমার নেশায় পরিণত হয়। এ সময় আমার সংগ্রহে দেশি প্রজাতির কবুতর ছিল। ২০০০ সালের শেষ দিকে আমি ফেন্সি পিজিয়ন বা সৌখিন পায়রার কথা জানতে পারি। ২০০১ সালে ঢাকা থেকে প্রথম আমি হাঙ্গেরিয়ান, রেড ডাউন ফেস, ইয়োলো ডাউন ফেস, হোয়াইট বিউটি হোমার, ব্ল্যাক বিউটি হোমারসহ বিভিন্ন জাতের দশ জোড়া ফেন্সি পিজিয়ন পাবনায় এনে খামার গড়ে তুলি। সেই থেকে যাত্রা শুরু। এখন আমার ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা বলতে শুধুই ফেন্সি পিজিয়ন।
মঞ্জিলের খামারে গিয়ে দেখা গেলো তার খামারে এখন রয়েছে ব্লু স্ট্রেচার, ইয়োলো স্ট্রেচার, ব্ল্যাক পোর্টার, ব্ল্যাক সিরাজি, বিউটি, জ্যাকুপিন, নরেশ কুপার, প্রমারিয়ান পোর্টার, ম্যাগপাই পোর্টার ব্লু, ব্ল্যার্ক হোমার, ব্লু কিং, এগজিবিশন, হোয়াইট ফিল ব্যাকসহ প্রায় অর্ধশত প্রজাতির শতাধিক জোড়া পায়রা। তার বাড়ির ছাদে গড়ে তোলা পায়রা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন গোবিন্দা মহল্লার আব্দুল্লাহ।
মঞ্জিলের খামার থেকে যে শিল্পের যাত্রা শুরু তা আজ বিস্তৃত হয়েছে শহর ও শহরতলীর বহু স্থানে। শহরের পাথরতলা, শালগাড়ীয়া, রাধানগর, যুগীপাড়া, কৃষ্ণপুর, পৈলানপুর, নুরপুর, সাধুপাড়া, নয়নামতিসহ সদর উপজেলার হেমায়েতপুর, মালিগাছা, মালঞ্চি, টেবুনিয়া, খয়েরসুতিতে এখন ছোটবড় মিলে প্রায় দেড় শতাধিক খামার নিয়ে ব্যস্ত সৌখিন খামারীরা।
এদের মধ্যে অনেক খামারী রয়েছেন, যাদের কাছে রয়েছে দুর্লভ প্রজাতির বেশকিছু ফেন্সি পিজিয়ন বা সৌখিন পায়রা।
শহরের শালগাড়ীয়া বুলবুল কলেজ গেট এলাকার খামারী আব্দুল মাজেদ বাংলানিউজকে জানান, তার সংগ্রহে দুর্লভ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে এক জোড়া হোয়াইট এলমন লং হেড এবং রেড এলমন লং হেড পায়রা।
শালগাড়ীয়া হাসপাতাল রোড এলাকার ফজলুল হক পলাশের সংগহে থাকা ব্ল্যাক ম্যাগপাই পোর্টার, ইয়োলো হেনা পোর্টার (স্প্যাঞ্জেল) ও সুশান্ত কুণ্ডুর সংগ্রহে থাকা পমেলিয়ান পায়রাগুলো অন্য খামারীদের কাছে ঈর্ষার বিষয়েই পরিণত হয়েছে। ফেন্সি পিজিয়নের খামার গড়ে পাবনার অনেক বেকার যুবক আজ স্বাবলম্বী। যাদের একজন সুশান্ত কুণ্ডু।
আলাপকালে কসাইপট্টি এলাকার সুশান্ত কুণ্ডু বাংলানিউজকে জানান, দেড় বছর আগে মাত্র ১ হাজার ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি ফেন্সি পিজিয়নের খামার গড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। এখন তার নিট প্রফিট দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ টাকায়।
পাবনার এই খামারের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খামারীরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানসহ অন্যান্য বেশকিছু বিষয় মাথায় রেখে একটি সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন। পাবনা ফেন্সি পিজিয়ন বিডার্স অ্যাসোসিয়েশন নামের এই সংগঠনটির একটি অস্থায়ী অফিস গড়া হয়েছে শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লায়। পায়রা ব্যবসায়ীদের আনাগোনার কারণে এরই মধ্যে জায়গাটির নামও হয়ে গেছে পায়রাতলা।
সংগঠনের সভাপতি হুমায়ুন কবীর রিপন বাংলানিউজকে জানান, তাদের সদস্য সংখ্যা এখন ৩০ জনের মতো। সারাদিনের কাজ সেরে পায়রার খামারীরা সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সংগঠনে এসে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করেন। এর পাশাপাশি নিজেরাও বিকিকিনি করেন সৌখিন পায়রা।
মূলত কখনো নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কখনো বা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এমনকি দেশের বাইরে থেকেও তারা এসব পায়রা সংগ্রহ করেন। বিদেশ থেকে আমদানি করা (রিং পরানো) পায়রার দাম অত্যধিক বেশি হয়। সে কারণে আগ্রহী খামারীরা রিং করা পায়রার ছানা সংগ্রহ করেন।
হুমায়ুন কবিরের কাছ থেকে জানা গেলো শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লার মঞ্জিল, কালাচাঁদপাড়া এলাকার ছোট হীরা, পাথরতলার রুমন, রাধানগরের নিপু, কৃষ্ণপুরের শামীম, শালগাড়ীয়ার সিববা, গণেশসহ প্রায় ৮ থেকে ১০ জনের সংগ্রহে রয়েছে দুর্লভ ও অরিজিনাল হল্যান্ড রিং পরানো সৌখিন পায়রার বেশ কয়েকটি জাত। সৌখিন পায়রার খামার গড়ে পাবনার খামারীরা দেশের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ স্থানে রয়েছেন।
প্রায় শূন্য থেকে খামার শুরু করা মঞ্জিল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, শখের বশে খামার গড়লেও এখন তা বাণিজ্যিক রূপলাভ করেছে।
তিনি আরও জানান, হল্যান্ড, জার্মানী, ইংল্যান্ড, আবুধাবীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে এসব অরিজিনাল জাতের সৌখিন পায়রা আসে। পাবনায় এখন যে সব জাত রয়েছে তার দাম ২৫ হাজার থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত।
মঞ্জিল হোসেন জানান, দুর্লভ প্রজাতির পায়রার ডিম থেকে বাচ্চা হলে তখন সেই বাচ্চা জোড়া প্রতি ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বা তার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করা হয়। এসব সৌখিন পায়রার ক্রেতা-বিক্রেতা খামারীরাই। নিজেদের সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য তারা অন্যান্য খামার থেকে অন্য জাতের পায়রা সংগ্রহ করেন।
এর বাইরে রাজশাহী, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগ্রহী খামারীরা পাবনার খামার দেখতে অথবা পায়রা সংগ্রহ করতে আসেন বলে জানান তিনি।
সৌখিন পায়রার খামার পাবনায় শিল্পে রূপ নিলেও এখনো প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের দেখা মেলে না পাবনার খামারীদের।
আলাপকালে খামারীরা বাংলানিউজকে জানান, পায়রাদের খাবার বলতে তারা গম, মটর, মশুর, ভুট্টা, ডাবলী, ছোলা, সরিষা, কুসুম ফুলের বিচি ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। খামারের পায়রাদের অসুখে-বিসুখে তারা বাধ্য হয়েই নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেরাই চিকিৎসা দেন। কখনো মানব দেহের ঔষুধ কখনো বা মুরগীর ঔষধ দিয়ে তারা পায়রার চিকিৎসা করেন।
গত দু`বছরে রোগ শনাক্ত করতে না পেরে পাবনার বিভিন্ন খামারের প্রচুর পায়রা মারা গেছে বলেও খামারীরা জানান।
সরকারিভাবে বিদেশ থেকে সৌখিন পায়রা আমদানির ব্যবস্থা করা হলে দুর্লভ প্রজাতির পায়রা খামারীরা সুলভ মূল্যে তা পেতে পারে বলে খামারীদের বিশ্বাস।
এর পাশাপাশি ফেন্সি পিজিয়ন ল্যাব গড়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মী গড়ে তোলা ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সহযোগিতা পাওয়া গেলে ফেন্সি পিজিয়ন শিল্পের মাধ্যমে পাবনাসহ দেশের হাজার হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থানের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে বলে খামারীরা অভিমত ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ সময়: ২২১০ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১২
সম্পাদনা : ওবায়দুল্লাহ সনি, নিউজরুম এডিটর