কোচবিহার শহর বড় ভালো লাগে বলেই ইলোরা হোটেলে মালামাল রেখেই রিকশা ধরে চললুম কোচবিহারের রাজপ্রাসাদে। ওখানে রাজবাড়ির মিউজিয়াম দেখে এলাম মদনমোহন মন্দিরে।
কৃষ্ণ প্রতিমা দর্শন করার জন্য অনুরোধ জানালো। কৃষ্ণর মুখেই শুনলাম, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় কোচবিহার ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ১৯৪৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কোচবিহারের রাজা জগদ্বীপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তির পর এই রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি কোচবিহার পশ্চিমবাংলার একটি জেলা হলো। বললাম, কৃষ্ণ তোমাকে তো খুউব ভালো লেগে গেছে। চলো না দু’জনে দূরে কোথাও চলে যাই ...। কথাটা শুনে ও মৃদু হেসে বললো- বারে তা কী হয়! আমি যে মন্দিরে মন্দিরে গান করি। বরং আপনি না’হয় আমার এখানে থেকে যান। রাত ৯টার দিকে মন্দিরে কীর্তন গাইবো তখন মন দিয়ে শুনবেন। রাতে আমার সঙ্গেই যেনো থাকেন।
কি আর করা! কৃষ্ণর কথায় রাজি না হয়ে কি পারা যায়। আমার হাতটি বুকে চেপে ধরে বললো, দাদা আপনি বাঙালি আমিও যে তাই। থেকে যান দু’দিন ভালো লাগবেই। এই বলে জড়িয়ে ধরে চুমু দিল ওষ্ঠে। তখন কী যেনো এক আনন্দের পরশ খুঁজে পেলাম।
এই কোচবিহারে রয়েছে ৫টি মহকুমা- কোচবিহার সদর, দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, মেখলিগঞ্জ আর তুফানগঞ্জ। তুফানগঞ্জের রসিক বিলের পাখিরালয় দেখলে তো ফিরে আসতে চাইবেন না।
গোঁসানিসারির কামতেশ্বরী মন্দির তো আরও অপূর্ব। আরও কি জানেন- এই কোচবিহার জেলা দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, তোরসা, রায়ডাক, জলঢাকা, সংকোশ, গদাধর, কালজানি নদী।
রাত নয়টা। মদনমোহন মন্দিরে কীর্তন গান চলছে। তাকিয়ে আছি। ভাবছি, কখন যে কৃষ্ণ গান ধরবে। এক সময় দেখি কৃষ্ণ ধুতি পরে খালি গায়ে জনতার সামনে এসে গান ধরলো :
‘মন ভোল না কথার ছলে। লোকে বলুক মাতাল বলে। সুধাপান করিনে রে আমি, সুধা খাই যে কৌতূহলে। আমার মন মাতালে মেতেছে আজ/মদ মাতালে মাতাল বলে/ অহর্নিশি থাকব বসে, হরমহিষীর চরণ তলে/ নৈলে ধরবো নেশা, ঘুচবে দিশা/ বিষম বিষয় মদ খাইলে .../ ত্রিগুণে তিনের জন্ম, মাদক বলে মোথের ফলে/ যত্নে ধর্ম, তনে মর্ম, কর্ম হয় মন রজ মিশালে/ মাতাল হলে বোতল পাবে, বৈতালী করিবে কোলে/ রামপ্রসাদ বলে, নিদান কালে/ পতিত হবে কুল ছাড়িলে ...। ’
কৃষ্ণর কণ্ঠে এ গান শুনে বারবার ওকে নিয়েই ভাবছিলাম। বসে আছি দেখি কৃষ্ণ পাশে এসে দাঁড়ালো। চলুন আমার ওখানে। কাল না হয় আপনার সঙ্গে দূরে কোথাও যাবো। খেয়ে দেয়ে দু’জনে শুয়ে আছি পাশাপাশি।
কৃষ্ণ বললো, দাদা, যুগ যুগান্ত ধরে বাংলাদেশ ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’ রূপে তাঁর ইষ্ট দেবতার ধ্যান করে এসেছে। তাই শ্যাম ও শ্যামা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর জগত্বারিণী বালিকা নয়- তারা বাঙালির বড় আদরের।
যশোদার নয়নমণি নন্দদুলাল কানাই, আর আর্ত হৃদয়ের একমাত্র আশ্রয় মা। তাই বাঙালি মূর্তি গড়ে নৈবেদ্য সাজিয়ে পূজা করেই আসেনি- তাদের মনের আকুলতা আবদার, ভালোবাসা, স্নেহ সবটুকু উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে গানে গানে।
মনের স্বাভাবিক প্রেরণাতেই সেই গানের সৃষ্টি। মনে যখন যে ভাব এসেছে- সরল, সহজ ভাষায় তাকে প্রকাশ করাই এই গানগুলো।
কৃষ্ণ গভীর রাতে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, দাদা এখন ঘুমান। আপনিতো মুসলমান। ফজরের আজান দিলে আপনাকে উঠিয়ে দিবো- তারপরে না হয় মসজিদে দিয়ে আসবো ...।
বোধ হয় কৃষ্ণ আমাকে বড্ড ভালোবাসে। সকালেই জানালো, চলুন ঘুঘুমারি, দিনহাটা হয়ে গীতলদহে। ওখানে এক সুন্দর মন্দির আছে। ওই মন্দির দেখিয়ে না হয় আপনাকে নিয়ে যাবো সীমান্তের কাছে। সেখানে গিয়ে নিজের দেশটিকে কাছ থেকে না হয় দু’নয়ন ভরে দেখবেন।
বললাম, হ্যাঁ কতদিন যে দেশটিকে দেখছি না। দেশের জন্য মন যে উতলা হয়ে আছে। কৃষ্ণ বললো, কেন আমাকে দেখে কী বাংলাদেশের রূপ, বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান না। কথাগুলো শুনে কৃষ্ণর পানে তাকিয়ে রইলাম।
কৃষ্ণই বললো, তোমাদের বড্ড কষ্ট হচ্ছে বুঝি! একটু ভেবে- তিস্তার জল তোমরা পাচ্ছো না ... আমরাতো দিতে চাই। কিন্তু যারা ক্ষমতায় বসে আছে ওরা যে বাধা দিচ্ছে। কথাগুলো শুনে মনে মনে ভাবলাম, কৃষ্ণ’র মধ্যে কতই না ভালবাসা আছে। কৃষ্ণ বললো, দাদা ভাবছেন কি? হাসলাম। চলুন দেখাবো তিস্তা নদী। দু’জনে গিয়ে ওখানেই স্নান করবো।
বেলা একটা। কৃষ্ণ ও আমি এলাম তিস্তার তীরে। দেখি জল থৈ থৈ করছে। ভাবলাম, দুজনে তিস্তায় স্নান সেরে নিই। কৃষ্ণ আমার হাত ধরে নদীতে নামিয়ে নিয়ে এলো। আনন্দই পেলাম। এবার কূলে ওঠে ভিজা কাপড় পাল্টিয়ে নিলাম।
দূরে দেখি শ্যামলগাঁও। এবার কৃষ্ণ গান ধরলোÑ অজানার ডাক এল ভাবনার বনছায়ে। ঐ শুনি বাণী তার দক্ষিণ বায়ে। আজি নব কিশলয় দল, মনে মনে হল চঞ্চল। কেন রঙে রসে উচ্ছল জানি না। অকারণ কী বেদনা এ। হে মধুর হে সুদূর থাক তুমি মন মাঝে। ফিরাবো না হেথা আর তোমারে কভু/ মিছে ভয় মিছে মোর লাজে/ সেথা শীর্ণ নদী ক্ষীণ ধারা, প্লাবন সলিলে হোক সারা। আমার তীরের নীড়ের মায়াতে। যাও তুমি যাও ভাসায়ে। অজানার ডাক এল...। ’
পরদিন কৃষ্ণ ও আমি এলাম গীতলদহে। এরই কাছে পিঠে বাংলাদেশ। দেখি সীমান্তে বিএসএফ পাহারা দিচ্ছে। কৃষ্ণ বললো, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই। বললাম, তা কী হয়! হাসলো। বারে আপনি এতোটা ভয় পাচ্ছেন কেন! এটা পশ্চিমবঙ্গ ওটা যে পূর্ববঙ্গ।
এখন তো আপনাদের দেশ বাংলাদেশ। শুনুন, আমি ভয় পাই না। নিজেকে বাঙালি ভাবি। এ জন্যই তো আপনাকে গীতলদহে নিয়ে এলাম।
হঠাৎ দেখি কৃষ্ণ গাইতে শুরু করলো ‘আমি ভয় করব না ভয় করবো না/ দুবেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না/তরী খানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে/তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি করব না। শক্ত যা তাই সাধতে হবে, মাথা তুলে রইব ভবে/ সহজ পথে চলব ভেবে পড়ব না, পাঁকের পরে পড়ব না/ ধর্ম আমার মাথায় রেখে চলব সিধে রাস্তা দেখে/বিপদ যদি এসে পড়ে সরব না ঘরের কোণে সরব না...। ’
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কৃষ্ণর দিকে। এদিকে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো ত্রিশ বয়সী আরেকজন। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম? একটু থেমে জানালো বিষ্ণু। আমিও মন্দিরে থাকি। আদি বাড়ি বাংলাদেশের গাইবান্ধায়।
১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলায় যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন বাবা ও মা গাইবান্ধা ছেড়ে আসতে চাইছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গাইবান্ধায় ক্যাম্প করার পরে স্থানীয় কয়েকজন দালাল আমার মাকে জোর করে ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়।
তখন আমার বয়স মাত্র ৪ বছর। পরে শুনেছি- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমার মাকে ধর্ষণ করে। ফিরে এসে মা সেই রাতে গলায় ফাঁস দেয়। আজ এতোদিন বাদে সে কথা মনে হলে, ওই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দালালদের ‘পশু’ বলেই গালি দিতে ইচ্ছে হয়।
জিজ্ঞাসা করলাম গাইবান্ধায় আর কী ফিরবে? বললো, সে ইচ্ছে নেই। দেখুন দাদা, ভারত ভেঙে কী লাভ হলো! না, দাদা, গাইবান্ধায় আর ফিরবো না। ফিরে কী লাভ। কথাগুলো বিষ্ণুর মুখে শুনে কোনই জবাব দিতে পারিনি।
তথ্য : আমার এ ভ্রমণ কাহিনী পড়ে যারা কোচবিহার যাবেন তাদের জ্ঞাতার্থে কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো:
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জায়গাগুলো হলো হলদিবাড়ি, হেমকুমারী, কুঠি, সিতাই, শীতলকুচি, মধুসূদন, জামালদহ, অনুকূল ঠাকুরের আশ্রম, চ্যাংরাবান্ধা, মেখলিগঞ্জ, দিনহাটা, বলরামপুর প্রভৃতি। কোচবিহার লালমনিরহাট হয়ে যাওয়া যায়। কলকাতা থেকে সড়ক পথে বাসে যাওয়া যায় তবে সময় লাগে ১৬ ঘণ্টা।
বাংলাদেশ সময় : ১৩৩৭ ঘন্টা, জুলাই ০৯, ২০১২
সম্পাদনা : সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর
kumar.sarkerbd@gmail.com;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর jewel_mazhar@yahoo.com