হুমায়ূন আহমেদ আমার পরিবারের একজন। পরিবারের কেউ মারা গেলে তাকে নিয়া কথা বলা যে কত কঠিন তা যার মরছে সেই জানে।
হুমায়ূন আহমেদ আমার মা`রে নিয়া একটা গল্প লেখছেন। সেই গল্পটার কথাই বলি না কেন! গল্পটার নাম ‘এলাচি বেগমের স্বদেশ যাত্রা’। এই এলাচি বেগমই আমার মা। কেমনে মা হইল সেই গল্পটাই বলি। তখন আমি একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ফারুক ভাইয়ের (ফারুক আহমেদ) সঙ্গে কাজ করছি। ঈদ সংখ্যার জন্য ফারুক ভাই আমারে একটা গল্প ধরাইয়া দিলেন কম্পোজে দিতে। কাজের এমনই চাপ যে কারো লেখা পইড়া কম্পোজে দেওয়ার সময় নাই। কিন্তু লেখকটা যদি হয় হুমায়ূন আহমেদ? কাজের গুষ্ঠি কিলাই, আগে পইড়া লই।
গল্পটা মোটামুটি এইরম: এলাচি বেগমের বয়স পয়ষট্টি। স্বামী ছয় বছর আগে মারা গেছে। বাড়িতে সে একা। তার একমাত্র ছেলে মোরশেদ লস এঞ্জেলেস থাকে। ছেলে মাকে লস এঞ্জেলসে নিয়া আসে। পরের দিন বাসা ফাঁকা পাইয়া তো এলাচি বেগম বরিশালের দিকে হাঁটা দেন। ছেলে, ছেলের বউ বাসায় আইসা হতভম্ব। বাঙালি পাড়া আর পুলিশ ডিপার্টমেন্টে তোলপাড়। রাত তিনটার সময় পুলিশ তাকে বাসা থেকে তেইশ মাইল দুরে খুঁজে পায়।
এই কাহিনী শুনে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, তোমার মার সঙ্গে আমার দেখা করার খুব শখ। তাকে একবার নিয়ে এসো তো। মোরশেদ জানাল যে মার তার সাথেই গাড়িতে আছে। সাদাসিদা সরল মহিলা। মাথায় হিজাব। তার মুখ থেকেই হুমায়ূন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কারণ শোনে :
বাড়িতে বিরাট ঝামেলা। আমার তেরটা হাঁস। এর মধ্যে দুইটা পাগলা। যেখানে-সেখানে ডিম পাইড়া থোয়। ডিম খুঁইজা আনতে হবে না?...
...বাবা, বলেন নিজের দেশের মাটি ছাড়া ঘুম হয়? নিজের দেশের মাটি দবদবায়া হাঁটি। ...
এলাচি বেগমের ছেলে হুমায়ূনকে জানাল যে সেও দেশে চলে যাচ্ছে। শুনে হুমায়ূন বললেন যে, তোমার দুই পুত্রকে নিয়ে যাও, যে পাগলা হাঁসের কথা শুনেছি, তাদের ডিম খুঁজে বের করতে হবে না?
আমরা লস এঞ্জেলসে থাকি না, ঢাকায় থাকি। তাইলে এলাচি বেগম আমার মা হইল কেমনে? আমার মা থাকেন গ্রামে, হাঁস-মুরগী পালেন, উঠানে লাউগাছ, পুঁইশাক লাগান, সকালে গাছের গোড়ায় পানি দেন। আমরা হাজার বুঝাইয়াও তাকে ঢাকায় থাকতে রাজি করাইতেই পারি নাই। গল্পটা পইড়া বুঝলাম হাঁসমুরগীর প্রতি আমার মায়ের দরদ আমাগো প্রতি দরদের চাইতেও কোনো অংশে কম না, তারে তার মতনই থাকতে দেওয়া উচিত।
তাইলে বলেন, হুমায়ূন আহমেদ আমার মারে নিয়া গল্প লেখছে কিনা? সে আমার পরিবারে লোক না হইলে আমার মারে চিনব কেমনে? তথাকথিত সিরিয়াস লেখকরা তো আমার, আমাদের সাধারণ পরিবারগুলার সদস্যই হইতে পারে নাই। আমরা তাগো লেখা পড়মু কেন? হুমায়ূন আবার এলাচি বেগমের লগে একটা ছবি তুলছেন। লেখার লগে সেইটাও ছাপতে দিছেন (ছবিটা এইখানে দেওয়া হলো)।
তাইলে বুঝেন, একটা চরিত্রের লগে, একজন পাঠকের লগে লেখকের আত্মীয়তা তৈরি করতে হয় কেন? বুঝেছেন ওগো সিরিয়াস, চাইলেই সিরিয়াস হওন যায় কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মতন সহজ ও জনপ্রিয় হওন যায় না।
লেখক: হুমায়ূন আহমেদের একজন পাঠক
বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক