পাভো নুর্মির বয়স মাত্র ১৫ বছর। খেলাধুলার প্রতি তার প্রচন্ড নেশা।
সেখানে ফিনল্যান্ডের হানেস নামে একজন দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতে নিল ৩টি গোল্ড ম্যাডেল। দেশের মানুষের উল্লাসের সঙ্গে কিশোর পাভোও মেতে উঠলো। কিন্তু তার মনে হয়ে গেল এক উত্তাল ঝড়। যে ঝড়ে সে নিজেও একজন দৌড়বিদ হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করলো।
সেই স্বপ্নই হয়ে গেল সত্যি। পাভো নুর্মিকে বলা হয় ‘দৌড়ের রাজা’। ১৯২০- ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তিনটি অলিম্পিক আয়োজনে পাভো জিতেছে নয়টি স্বর্ণ পদক, তিনটি সিলভার।
যাইহোক, এবার পাভোর গল্পে ফিরে আসি। পাভোর জন্ম ১৮৯৭ সালের ১৩ জুন ফিনল্যান্ডে। ১৯১২ সালে হানেস যখন ফিনল্যান্ডের হিরো হয়ে গেল তখন থেকেই পাভোর প্রস্তুতি শুরু। সারাদিন ভাবতে থাকেন, একদিন তিনিই হবেন পৃথিবী বিখ্যাত দৌড়বিদ। পাভো একজোড়া জুতা কিনে প্রতিদিন ব্যায়াম করা শুরু করলো।
প্রথমে কয়েকমাস ব্যায়াম তারপর থেকে তিনি হাঁটা শুরু করলেন। এরপর দৌড়ের চর্চা। দৌড় দেওয়ার দূরত্বও বাড়াতে থাকলেন। সঙ্গে সবসময় তিনি একটি ঘড়ি রাখতেন। প্রতিদিন একই দূরত্বে পৌঁছাতে তার কত সময় লাগে এই বিষয়টি তিনি শুরু থেকেই মাথায় রাখতেন।
এভাবে দুইবছর তিনি শুধু প্রশিক্ষণ ও চর্চার মধ্যে দিয়েই গেছেন। ১৯১৪ সালের শুরুতে পাভো তার নিজ এলাকার একটি ক্লাবে যোগ দেন। এই ক্লাব থেকেই পাভোর যাত্রা শুরু । ফিনল্যান্ডের জাতীয় দৌড় প্রতিযোগিতায় পাভোর নাম ছড়াতে শুরু করে। নিয়মতান্ত্রিক জীবন ও চর্চা পাভোকে এনে দিচ্ছিল একের পর এক সাফল্য।
এরপরই কাঙ্খিত সময় তার হাতে ধরা দেয়। ১৯২০ সালে আবার অলিম্পিকের আসর বসে। সেখানে প্রথম খেলা হবে ৫ হাজার মিটার দৌড় প্রতিযোগিতা। খুব দুঃখের বিষয় ছিল সেই প্রথম প্রতিযোগিতায় পাভো হেরে গেলেন।
অনেকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পাভো সেদিন এতটাই উত্তেজিত ও বিষ্মিত ছিল যে অলিম্পিকের প্রথম ধাক্কাটা সে সামলে উঠতে পারছিল না। ’ এ ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার প্রথম প্রতিযোগিতা। তার কয়েকদিন পরই অলিম্পিকের ১০ হাজার মিটার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ পদক জিতে অলিম্পিক আসরের সবার আলোচনায় চলে আসে।
সেখান থেকেই শুরু পাভো নুর্মির। সম্রাটের বেশে একের পর এক রেকর্ড ভাঙা শুরু করেন পাভো। ১৯২১ সালের একটি প্রতিযোগিতায় তিনি সবচেয়ে কম সময়ে ১০ হাজার মিটার দৌড়ে রেকর্ড গড়েন। যেটি এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি।
তবে পাভোর রেকর্ড গড়ার যাত্রা হয় ১৯২৪ সালের প্যারিসে আয়োজিত অলিম্পিকে। মাত্র ছয়দিন না যেতেই পাঁচটি স্বর্ণ পদক জেতে পাভো। মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ১ হাজার মিটার এবং ৫ হাজার মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় তিনি স্বর্ণ জেতেন। এই বিজয়ে সবাই এতই তাক লেগে যায় যে তখন থেকেই নামের পাশে ‘দৌড়ের রাজা’ খেতাব লেগে যায়।
পাভো নুর্মি যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হতে শুরু করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একটি প্রদশর্নীতে অংশ নেন। তখন যুক্তরাষ্ট্র মিডিয়া তাকে ‘ফ্লাইং ফিন’ নামে অভিহিত করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক নানা বিতর্কে ও নিয়ম ভঙ্গের দায়ে তাকে সকল আন্তর্জাতিক খেলা থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
এরপর থেকে তিনি আর আন্তর্জাতিক খেলায় ফেরেননি। তবে জাতীয় পর্যায়ে একটানা খেলে গেছেন। সঙ্গে নিজ দেশের তরুণ প্রতিভাদের জন্যও কাজ করে গেছেন। খেলার পাশাপাশি তিনি ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। একসময় সেখানেই ব্যস্ত হয়ে ওঠেন পাভো নুর্মি।
তবে ফিনল্যান্ডে যখন আবার অলিম্পিক ফিরে আসে তখন পাভোকে বিশেষ সম্মান দেয় ফিনল্যান্ড সরকার। অলিম্পিকের মশাল হাতে মাঠে প্রবেশ করেন পাভো নুর্মি। বহুদিন পর প্রিয় পাভোকে দেখে দর্শকরা সেদিন চোখের জলে একাকার হয়ে গিয়েছিল। পাভোও মশাল হাতে কাঁদছিলেন। এ যেন তার শেষ মাঠে আসা। এরপর আর কখনই দেখা যায়নি পাভোকে।
পাভো নুর্মি মারা যান ১৯৭৩ সালে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে বিশেষ সম্মান জানানো হয়। তার নামে অসংখ্য বই এখনও লেখা হয় ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডে তিনি জাতীয় নায়ক হিসেবে এখনও তরুণদের মাঝে জনপ্রিয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৯, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক