ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র সিলেটের ঐতিহ্য শাহী ঈদগাহ

সাব্বির আহমদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:১৩, জুলাই ৩১, ২০১২
প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র সিলেটের ঐতিহ্য শাহী ঈদগাহ

সিলেট: উপমহাদেশের প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র সিলেটের শাহী ঈদগাহ। স্থানটি ধারণ করে আছে সিলেটের কয়েক শত বছরের ঐতিহ্য।

দেশের প্রাচীনতম ঈদগাহ হিসেবেও পরিচিত এ ঈদগাহে প্রতি বছর লাখো মানুষ নামাজ আদায় করেন।

পাহাড়ের টিলায় সবুজ আচ্ছাদিত পরিবেশে এ ঈদগাহ কেবল ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারকই নয়, নগর জীবনে প্রশান্তির কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছে।

সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে এ সম্পর্কে জানা গেছে, শাহী ঈদগাহ সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের এক নিদর্শন।

আরো জানা গেছে, মনোমুগ্ধকর কারু কার্যময় এ ঈদগাহটি মোগল ফৌজদার ফরহাদ খাঁ নির্মাণ করেন। তখন মোঘল সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব। এখানে একসঙ্গে প্রায় দেড় লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেন।

পাহাড়, টিলা আর হাজারো বৃক্ষরাজির মধ্যে এর মনোমুগ্ধকর অবস্থান যে কারো নজর কাড়ে। ঈদগাহের উত্তরে শাহী ঈদগাহ মসজিদ, পাশে সুউচ্চ টিলার ওপর বন কর্মকর্তার বাংলো, দক্ষিণে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিলেট উপ-কেন্দ্র, পূর্ব দিকে হযরত শাহজালাল(র.) এর অন্যতম সফরসঙ্গী শাহ মিরারজী (র.) এর মাজার এবং এর পাশের টিলার ওপর রয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।

ঈদগাহের চারপাশ পাকা সড়কপথ আর সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ঈদগাহ ঘিরে রয়েছে দেশি-বিদেশি কয়েকশ’ প্রজাতির বৃক্ষারাজি।

স্থানটি এখন নানা কারণে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। এখানেই হাদা মিয়া ও মাদা মিয়া ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ইংরেজ বিরোধী প্রথম অভ্যুত্থান হয়েছে। ভারতের অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের মতো নেতারা এখানে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। অতীতে সিলেটের বড় বড় সমাবেশের স্থানও ছিল এটি।

এ সম্পর্কে লেখক ও গবেষক এবং মদন মোহন কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বাংলানিউজকে জানান, ১৭৮২ সালের মহররম মাসে প্রথম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয় এই ঈদগাহ ময়দানে। তখন রবার্ট লিন্ডসে ছিলেন সিলেটের কালেক্টর। ঈদগাহ ময়দানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে এমন খবর পৌঁছে তার কাছে। প্রকৃত পক্ষে তখন মহরম মাস উপলক্ষে ঈদগাহ ময়দানে তাজকিয়া মিছিল চলছিল।

তিনি জানান, এ মিছিলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।   আর তখনই শুরু হয় সম্মুখ সমর। রবার্ট লিন্ডসের পিস্তলের গুলিতে শহীদ হন আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ মোহাম্মদ হাদী ও তার ভাই মাহদী নামে দুই ধর্মীয় নেতা। মূলত তারাই উপমহাদেশের ব্রিটিশ আন্দোলনের প্রথম শহীদ বলেও উল্লেখ করেন গবেষক ফতেহ ফাত্তাহ।  

তিনি আরো জানান, শাহী ঈদগাহের পাশে নয়াসড়ক মাদ্রাসার ঠিক পূবর্দিকে এবং গীর্জার পশ্চিমপাশে  তাদের দুই ভাইয়ের কবর রয়েছে। তবে এই ঐতিহাসিক করবরটি দুটি এখনো সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ইতিহাস সংরক্ষণের প্রয়োজনে এ দু’টি কবর সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

গবেষক ফাত্তাহ আরো বলেন, ঐতিহাসিক কালপ্রবাহে সিলেট শহরের প্রাচীনত্ব এখন ৭০০ বছরের বেশি। সিলেটের আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক কেন্দ্রবিন্দুতে শহর সিলেটের অবস্থান। আর এসবের অন্যতম সাক্ষী সিলেটের শাহী ঈদগাহ।

সরেজমিনে শাহী ঈদগাহ ঘুরে দেখা গেছে, প্রাচীনতম স্থাপত্যশৈলীর এই নিদর্শন ঈদগাহের মূল ভূ-খণ্ডে ২২টি সিঁড়ি মাড়িয়ে উঠতে হয়।

উচু টিলার ওপরই ১৫টি গম্বুজ সজ্জিত মূল ঈদগাহ। টিলার মূল ঈদগাহের সামনের দিকে ৮টি গুম্বুজ। নিচে বিস্তৃত বৃক্ষ ছায়ায় বিস্তৃত মাঠ এবং  সীমানা প্রাচীরের চারদিকে রয়েছে-ছোট বড় ১০টি গেট। তবে ঈদগাহের সামনের দিকে রয়েছে মূল তিনটি গেট।

মূল তিনটি গেটে মুঘল আমলের স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট। ২০০১ সালে বড় পরিসরে ৩টি গেটের নির্মাণ করে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজারীবাগ নীরু মঞ্জিলের বাসিন্দা জহির উদ্দিন তারু মিয়া। ওই বছরের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর উদ্বোধন করেন।

এছাড়া এর আকর্ষণ ঈদগাহের ভেতরের সামনের দিকে ওজু করার জন্য রয়েছে বিশাল পুকুর। পুকুরে স্থাপন করা আছে কৃত্রিম ফোয়ারা। তবে ফোয়ারাটি এখনা অযত্ন-অবহেলায় অচল। ফোয়ারাটির দায়িত্বে সিলেট সিটি কর্পোরেশন থাকলেও এর কোনো দেখভাল করছে না কর্তৃপক্ষ-এমন অভিযোগ রয়েছে।

ঈদগাহের ভেতরের ফলক অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান পুকুরের চারদিকে ঘাট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পুকুরটির চারপাশে বৃক্ষের সমারোহ দিন-দুপুরে ক্লান্ত মানুষের নি:শ্বাস ফেলার আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে।

বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মহিত ২০১০ সালের ২৯ অক্টোবর ঈদগাহে বিদ্যুতায়ন, সংস্কার ও চারদিকে ফুটপাত নির্মাণ করেন।

দীর্ঘদিন ধরে ঈদগাহের দেখাশোনা করছে ৪৫ সদস্যের একটি ঈদগাহ পরিচালনা কমিটি। এর মোতোয়াল্লি স্থানীয় বিশিষ্ট মুরব্বী জহির বক্ত।

তবে ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির একজন আক্ষেপ করে বাংলানিউজকে বলেন, সারা বছর কেবল মোতোয়াল্লি ছাড়া আর কেউ এই ঐতিহাসিক স্থানটির দেখাশোনা করেন না।

বাংলাদেশ সময়:  ১৬০৭ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১২
এসএ/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।