ফুলবাড়ীয়া (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে : জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ২৩ টি বছর এখন মোসলেম উদ্দিন সরকারের কাছে এক বিপন্ন বেদনা। পেছনে ফেলে আসা ২৩টি বছরের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তার নিজের এবং পরিবার-পরিজনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিপর্যয়ের প্লাবণ।
ঠিক যেন ৬০ দশকের ‘সবার উপরে’ ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ ‘ফিরিয়ে দাও আমার ১০ টি বছর’ এর মতো মোসলেমের (৫২) বিমূর্ত আর্তি ‘ফিরিয়ে দাও আমার ২৩ টি বছর। ’
১৯৮৯ সাল থেকে ২০১২, ২৩ বছর পর দেশে ফেরেন মোসলেম। এর মধ্যে ১৫ বছর কেটেছে পাকিস্তানের কারাগারে। গত ৩১ জুলাই মঙ্গলবার বিকেলে পাকিস্তানের করাচির একটি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আসেন মোসলেম উদ্দিন সরকার। মোসলেম উদ্দিন সরকারের আগমনকে ঘিরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের বিষ্ণুরামপুর গ্রাম এখন আবেগ-আনন্দ আর উত্তেজনায় ভাসছে।
গ্রামের মানুষের কাছে তিনি অপরিচিত এক প্রৌঢ়। গ্রমের মানুষ এমনকি চারিদিকের পরিবেশও মোসলেম উদ্দিনের কাছে অচেনা। অশীতিপর মা জয়নব বিবি চোখে কম দেখেন। যেদিন মোসলেম এলেন তার কাছে সেইদিন মমতাময়ী মা বিস্ফারিত চোখে দৃষ্টি মেললেন। খুঁজে নিলেন তার বিচ্ছিন্ন রক্তকে পরম মমতায়।
বুকের মানিককে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে মা জয়নব বিবি বললেন, “বাজান তোমারে দেখার লেইগাই আল্লাহ আমাকে বাঁচাইয়া রাখছে। ২৩ টা বছর তোমার পথ চাইয়া আছি। সবাই কইছে তুমি নাই, মইরা গেছ। মায়ের মন ঠিকই বুঝে। তুমি বাঁইচা আছ। ”
মা-ছেলের এমন আবেগঘন মিলন সেইদিন ফুলবাড়ীয়া’র বিষ্ণুরামপুর গ্রামে উপস্থিত সব শ্রেণির লোকজনের চোখে এনে দেয় আনন্দাশ্রু। এরপর গত দু’দিনে গ্রাম ছাড়িয়ে উপজেলাব্যাপী খবর রটে যায় ২৩ বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষটি আবার ফিরে এসেছে। তাকে দেখতে যারপরনাই দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে ভিড় করে।
বুধবার বিকেলে এই প্রতিনিধির সাথে কথা হয়েছে এ আলোচিত ব্যক্তির। যার জীবন কাহিনী সিনেমায় দেখা গল্পের মতো। মোসলেম উদ্দিন বলেন, “মাত্র ১২ বছর বয়সে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কাজের জন্য গিয়েছিলাম। সেখানে বন্দরে ডক শ্রমিকের কাজ নেই। এরপর ১৯৮৯ সালে ক’দিনের জন্য বাড়িতে থেকে ফের চট্টগ্রামে যাই। ”
তারপর থেকেই মোসলেম নিখোঁজ। পরিবার এমনকি গ্রামবাসী ধরেই নিয়েছিল সে আর নেই।
“সেই সময়টায় কী ঘটেছিল” জানতে চাইলে ফের কথা বলতে শুরু করেন মোসলেম উদ্দিন। তবে দীর্ঘদিনের বিরতিতে তিনি মায়ের ভাষা বাংলা অনেকটাই ভুলে গেছেন। এখন উর্দুতে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারেন।
তিনি বলেন, “১৯৯৭ সালে সিলেট সীমান্তের জকিগঞ্জ হয়ে ভারতের করিমগঞ্জে যাবার পর পাঞ্জাব সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলাম। পাসপোর্ট না থাকায় পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষীরা আমাকে আটক করে পুলিশে দেয়। এরপর পাঞ্জাব ও লাহোর সেন্ট্রাল জেলে ১৫ বছর আটক ছিলাম বিনা দোষে। ’
মোসলেম উদ্দিন আরো বলেন, “লাহোর সেন্ট্রাল জেলে রেডক্রস কর্মীরা অন্য বন্দিদের নিয়ে কাজ করছিল। এসময় আমি রেডক্রস কর্মীদের কাছে আমার ঘটনা জানাই। এরপর আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা মঙ্গলবার বিকেলে বিষ্ণুরামপুর গ্রামে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। ’
এরপর একটু থেমে ক্ষীণ স্বরে মোসলেম উদ্দিন বলেন, “ভাবতে পারিনি দেশে ফিরতে পারবো। মাকে দেখার আকুতি সব সময় আমাকে তাড়া করতো। ”
পাকিস্তানের কারাগারে বিনা দোষে ১৫ বছর জেল খাটার বিষয়টি বলতে গিয়ে চোখে পানি আসে তার। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন, “আমি বাঙালি হওয়ায় পাকিস্তানি কারারক্ষীরা আমাকে শত্রু মনে করতো। আমাকে প্রায়ই নির্যাতন করতো। ”
শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে তিনি বলেন, “জেল জীবনে কারারক্ষীরা আমার নিচের দাঁতও তুলে নিয়েছিল। আমাকে ওরা অসহ্য রকমের কষ্ট দিতো। ” এরপর আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
মোসলেমের ছোট ভাই সেকান্দর আলী (৩৫) জানান, “প্রায় দেড় মাস আগে মোসলেম উদ্দিন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন বলে স্থানীয় রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুরুজ চৌধুরীর কাছে একটি ফোন আসে। খবর পেয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা রেডক্রসের সাথে যোগাযোগ করি। পরে রেডক্রস মোসলেমকে পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। ”
দীর্ঘ সময় পাকিস্তানের কারাগারে থাকা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয় মোসলেম উদ্দিনের কাছে। মায়ের বুকে ফিরে আসার পর তিনি বলেন, “এ আনন্দটা বলে বোঝানোর মতো নয়। ”
“ভবিষ্যতে কী করবেন?” প্রশ্ন শুনে একবাক্যে উত্তর দিলেন, “আপাতত এ ব্যাপারে ভাবছি না। ”
ফুলবাড়ীয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুরুজ চৌধুরী বলেন, “সবাই জানতো মোসলেম মারা গেছে। কিন্তু ও এতো বছর পর নিজ গ্রামে নিজের পরিবারের কাছে ফিরে এসেছে। আমাদের কাছে এরচেয়ে বড় আনন্দের সংবাদ আর কী হতে পারে?”
বিয়ে করি নাই, সাংবাদিকরা ভুল লিখেছে
এদিকে, ভারতে মোসলেম বিয়ে করেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে জানানো হলেও এ ব্যাপারে মোসলেম বাংলানিউজ প্রতিনিধিকে কিচু জানাননি। এ বিষয়ে সেলফোনে ফের তাকে জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করেন।
মোসলেম উদ্দিন সরকারের ছোট ভাই সেকান্দার আলীর ছেলে আবুল খায়েরের মাধ্যমে মুঠোফোনে বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৮ টায় ফের কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, “মনে আছে ১৯৮৯ সালে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। আসাম ও মেঘালয়ে ছিলাম মাস কয়েক। পরে নয়া দিল্লিতে আমি ৩মাস। ”
“সেখানে বিয়ে করেছেন কি? এ প্রশ্নের উত্তরে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আমি দিল্লিতে বিয়ে করি নাই। তবে অনেক সাংবাদিক এ ব্যাপারে ভুল তথ্য দিয়েছে। আমি আমার পরিবারের লোকজনের কাছেও এ বিষয়ে বলেছি যে আমি বিয়ে করি নাই। আমার সাথে কথা না বলেই তারা (সাংবাদিকরা) এ খবর দিয়েছে। ”
পাকিস্তানের জেলে যাবার আগে মোট ৮ বছর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে ফিরে তার সময় কেটেছে বলে জানান তিনি।
মোসলেম আরো বলেন, “পাকিস্তানিরা ভেবেছিল আমি বাংলাদেশি গুপ্তচর। কিন্তু আমি মূলত পাকিস্তানে গিয়েছিলাম কাজের উদ্দেশ্যে। বেশি লোভ করে যাওয়াটাই আমার জীবনে এ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। ”
তিনি বলেন, “চট্টগ্রামে ডক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যে বেতন পেতাম তা দিয়ে দিন চলতো না। এ কারণেই বেশি টাকা কামাতে বিদেশ যেতে চেয়েছিলাম। ”
মোসলেম উদ্দিনের ভাতিজা আবুল খায়ের বলেন, “চাচা বিয়ে করে নাই। দাদি, আব্বা-আম্মা সবাই এ ব্যাপারে তাকে বারবার জিজ্ঞাস করেছিল। তিনি না করেছেন। এরপরেও সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে লিখেছে। ”
বাংলাদেশ সময় : ২১৩৪ ঘণ্টা, আগষ্ট ০২, ২০১২
সম্পাদনা: ইয়াসিফ আকবর, নিউজরুম এডিটর; াহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর