ঢাকা: গত সোমবার সৌরজগতের লাল গ্রহ মঙ্গলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির রোবট কিউরিওসিটির অবতরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে তার দীর্ঘ দুই বছরের মিশন। সঙ্গত কারণেই এ রোবটকে বলা হচ্ছে ‘পূর্ণাঙ্গ জৈব গবেষণাগার’।
এখন অপেক্ষার পালা-- অত্যাধুনিক এ যানটি মঙ্গল সম্পর্কে আমাদের আর কী চমকপ্রদ তথ্য দিতে পারে।
মঙ্গলে কিউরিওসিটির অবতরণ প্রক্রিয়াটিও ছিল বেশ উত্তেজনাকর। একটি ‘স্কাইক্রেনের’ সহায়তায় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মঙ্গলপৃষ্ঠে একটি নিখুঁত অবতরণ সম্পন্ন করে রোবটটি। স্কাইক্রেন হচ্ছে রকেট ইঞ্জিনযুক্ত একটি যান যা পতনবেগ কমিয়ে কোনোপ্রকার ক্ষতিসাধন ছাড়াই রোবটটিকে মঙ্গলপৃষ্ঠে নামতে সহায়তা করেছে।
অত্যাধুনিক আর জটিল প্রযুক্তিসমৃদ্ধ নাসার এই রোবটটির আকার মোটামুটি একটি প্রাইভেট কারের সাইজের মত। ঘণ্টায় ১৩ হাজার মাইলের এক অবিশ্বাস্য গতি নিয়ে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে তাকে বহনকারী ক্যাপসুল অ্যারোশেল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রায় একশ’ ভাগ পাতলা এ বায়ুমণ্ডলে ভীষণ গতিতে ধাবমান একটি যানের বেগ কমিয়ে এ ধরনের মসৃন অতরণ ছিল সত্যিই কঠিন।
অবশ্য মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের গ্যাস অ্যারোশেলের তাপবর্মের সঙ্গে প্রতিরোধ তৈরি করে এর গতি দ্রুত ঘণ্টায় এক হাজার মাইল করে কমিয়ে দিয়েছে। তারপরও শেষ পর্যন্ত যে গতি অবশিষ্ট ছিল তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে যথেষ্ট আলতোভাবে এবং সঠিক স্থানে একটি অবতরণের জন্য প্রয়োজন হয়েছে স্কাইক্রেন নামে আলাদা মহাকাশ যানের।
পৃথিবীর যমজ বোন হিসেবে খ্যাত মঙ্গলে কিউরিসিটির অবতরণ নানা কারণেই ইতিহাস গড়েছে। মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এযাবতকালে এই গবেষণা রোবটটি বৃহত্তম এবং সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির। প্রায় এক টন ওজনের সূক্ষাতিসূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি সজ্জিত এ রোবটটি যেন বৈজ্ঞানিক কোনো কল্পকাহিনী থেকেই উঠে এসেছে।

এমন একটি মিশনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (নাসা) খরচ করতে হয়েছে প্রায় আড়াইশ’ কোটি ডলার।
একেই বলা হচ্ছে মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি। নামকরণটি যথার্থ বলা যায়। নাসার ভাষায়, কিউরিওসিটি মঙ্গলের আবহাওয়া এবং পরিপার্শ্বে ‘খুঁড়তে’, ‘স্বাদ’ নিতে এবং ‘গন্ধ’ নিতে পারবে।
আর এ কাজ দক্ষতার সঙ্গে করার জন্যে এতে রয়েছে, ডজনখানেক ক্যামেরা, লেজার এবং জলবায়ু স্টেশন। মঙ্গলে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জৈব গবেষণাগার হিসেবে কাজ করবে।
পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরুর পর মঙ্গলে পৌঁছানো পর্যন্ত কিউরিওসিটি আট মাস ধরে ৫৬০ মিলিয়ন কিলোমিটারের আন্তঃগ্রহ পথ অতিক্রম করেছে।
এবারকার মঙ্গল মিশনের প্রধান কাজ হলো, লোহিত গ্রহটির বিশাল আকৃতির আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ (গর্ত) গেইলের ভূতত্ত্ব সম্পর্কে জানা। রোবটটি এর লেজার ব্যবহার করে সেখানকার শিলাখণ্ড ছিদ্র বা দহন করে এ গ্রহের প্রাচীন আবহাওয়া ও জলবায়ু জানার চেষ্টা করবে। এতে জানা যাবে, মঙ্গল কখনো আনুবীক্ষণিক জীব বসবাসের উপযোগী ছিল কি না।
কিউরিওসিটি ইতোমধ্যেই ছবি পাঠানো শুরু করেছে। অবশ্য দূরত্বের কারণে সেসব ছবি দেখতে পৃথিবীতে ১৪ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়।
নাসার এ উচ্চাভিলাষী মিশনের মূল কাজটি হলো- মঙ্গলে কখনো জীবনের অস্তিত্ব ছিল কি না এবং এখন সেখানে জীবনধারণের মতো পরিবেশ আছে কি না বা ভবিষ্যতে সে অবস্থা তৈরির সম্ভাবনা আছে কি না তা জানা।
এছাড়া, পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর বসবাস আছে কি না- বহু প্রাচীন এ দার্শনিক প্রশ্নের উত্তরও খোঁজার প্রয়াস থাকবে এ মিশনে।
তবে কিউরিওসিটিতে সর্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি এবং পরীক্ষণ কৌশল থাকলেও সে সরাসরি জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে সক্ষম নয়। এর মানে হলো- আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে মঙ্গলের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু এবং বস্তুর গঠন প্রকৃতি বিশ্লেষণ করবে রোবটটি।
বিষয়টি পরিষ্কার করে বললে এরকম; কিউরিওসিটি কেমক্যাম নামে একটি সংবেদনশীল যন্ত্রের সাহায্যে সাত মিটার দূরের কোনো শিলার উপরিস্তর বাষ্পায়িত করতে সক্ষম। এ যন্ত্র বাষ্পায়িত শিলা বিশ্লেষণ এবং এর মধ্যকার খনিজ উপাদান সনাক্ত করতে পারবে। ভিনগ্রহে পাঠানো কোনো যানে এ-ই প্রথম এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন লেজার সংযোজন করা হয়েছে।
এতে আরো কয়েকটি ক্যামেরা সংযুক্ত আছে যারা মঙ্গলের বৈচিত্রময় ভূপ্রকৃতির উচ্চমানের ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠাবে।
অন্য যন্ত্রপাতিগুলো মঙ্গলের আবহাওয়ার অবস্থা পরীক্ষা করবে। আরো আছে একসেট স্পেক্টোমিটার যা মঙ্গলের মাটি পরীক্ষা করে দেখবে এতে কোনো জৈব পদার্থের অস্তিত্ব রয়েছে কি না। এছাড়া মঙ্গলপৃষ্ঠের ঠিক নিচের স্তরেই পানির বরফের অস্তিত্বও খুঁজবে কিউরিওসিটি।
কিউরিওসিটি আরো একটা বিষয় বোঝার চেষ্টা করবে। তা হলো, মঙ্গলের পরিবেশ কোনো একদিন মানুষের মতো প্রাণীর বাস উপযোগী হয়ে উঠবে কি না।
মঙ্গলে পানির অস্তিত্ব নিয়ে এর আগে অনেক কথা হয়েছে। নাসা আগে বরফের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা বলেছিল। এখন তাদের ধারণা সঠিক হওয়া মানেই এ গ্রহে জীবনের অস্তিত্ব অনেকটা নিশ্চিত হওয়া।
এ ব্যাপারে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ফ্রান্সিসকো ডিয়েগো বলেন, “এ মিশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পাঁচ হাজার মিটার উচ্চতার সুউচ্চ আগ্নেয়গিরি পর্বতের বিভিন্ন স্তরের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করবে এটি। কোটি কোটি বছর ধরে পলি ও শিলা জমে তৈরি হয়েছে এ পর্বতের বিভিন্ন স্তর। ”

মিশনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী ও মিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পর্যবেক্ষক গ্রুপের সদস্য লুথার বিগল বলেন, “এটা জীবন অনুসন্ধানের মিশন নয়। এটা হলো বাসোপযোগিতা পরীক্ষার মিশন। জীবনের সূত্রপাতের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ মঙ্গলে কখনো ছিল কি না-- এ প্রশ্নের উত্তর পেলে আমরা জীবনের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে পরে আরেকটি মিশন পাঠাতে পারি। ”
আমাদের ছায়াপথ (মিল্কিওয়ে) ছাড়া অন্য গ্যালাক্সিতে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানী থেকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অতিউৎসাহী লেখকদের মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। তবে সামর্থ্যের মধ্যে নাসা আপাতত সৌর জগতে পৃথিবীর কাছাকাছি মঙ্গলে সেই কল্পনা ও আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এ প্রত্যাশায় এর আগে অনেকগুলো মিশন পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলোই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু মানুষের অনুসন্ধানী ও সৃষ্টিশীল মনের কাছে এসব ব্যর্থতা একপর্যায়ে হার মেনেছে। তার প্রমাণ, কিউরিওসিটির নিরাপদে মঙ্গলে অবতরণ।
মঙ্গলে পূর্বের মিশনগুলোর একটা তালিকা থেকে তা অনুমান করা যায়:
১৯৬০’র দশকের শুরুর দিকে লাল গ্রহ মঙ্গলে ডজনখানেক মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে। অবশ্য সবই প্রায় ব্যর্থ।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিনার-৪ প্রথম মহাকাশযান যা প্রথম মঙ্গলের কাছ দিয়ে উড়ে যায়। ১৯৭১ সালে ম্যারিনার-৯ এ প্রতিবেশী গ্রহটির ছবি পাঠাতে সক্ষম হয়।
১৯৭৫ সালে দু’টি ভাইকিং মহাকাশযান মঙ্গলে বর্তমান বা অতীতে জীবনের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে পাঠানো হয়। ছয় বছরের প্রচেষ্টায় এরাই ছিল প্রথম মহাকাশযান যারা মঙ্গলের মাটিতে অবতরণ করে এবং সঙ্কেত পাঠায়।
এরপর পাথফাইন্ডার এবং গ্লোবাল সার্ভেয়র পাঠানো হয় ১৯৯৬ সালে। এ মিশনে পাথফাইন্ডারের কাজ ছিল মঙ্গলের মাটি ও শিলার রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করা।
২০০১ সাল থেকে মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে মার্স ওডিসি। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করার ইতিহাস তৈরি করে এ যানটি। এ যান গ্রহটির পৃষ্ঠ জরিপ করে এবং পৃষ্ঠের নিচের তলে পানির অনুসন্ধান চালায়।
২০০৩ সালে বড় আকারে মিশন পাঠায় নাসা। এসময় সেখানে দু’টি অনুসন্ধানী রোবট পাঠানো হয়। অপরচুনিটি ও স্পিরিট নামে রোবট দু’টি লাল গ্রহটির ভূপ্রকৃতি জরিপ করে।
সর্বশেষ ২০০৫ সালে পাঠানো হয় মার্স রিকনেইস্যান্স অরবিটার। যানটি মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশের উচ্চ মানের ছবি পাঠাতে সক্ষম হয় যা এর আগে কোনো মিশনে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ২২৫৩ ঘণ্টা, ০৮ আগস্ট, ২০১২
সম্পাদনা: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর; সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর