বলা হয়, পাখি দেখেই মানুষের উড়ে বেড়াবার সাধ জেগেছিল। কিন্তু সাধ হলেই কি ওড়া যায়! তারপরও কেউ কেউ নানাভাবে আকাশে উড়তে চেষ্টা করেছেন।
কোনো একক ব্যক্তি বিমান আবিষ্কার করেনি। তারা ছিলেন আপন দুই ভাই। উইলবার রাইট আর অরভিল রাইট। উইলবার রাইট জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৬৭ সালে। তিনি মারা যান ১৯১২ সালে। অরভিল রাইটের জন্ম ১৮৭১ সালের ১৯ আগস্ট। তিনি মারা যান ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি।
খুব ছেলেবেলা থেকেই দুই ভাইয়ের মধ্যে ছিল প্রবল কল্পনাশক্তি এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। শৈশবকালের পড়াশোনা শেষ করে দুই ভাই হাতে কলমে কাজ করার জন্য ছোট কারখানা তৈরি করলেন। প্রথমে তারা কিছুদিন বাজারে প্রচলিত ছাপার যন্ত্র নিয়ে কাজ শুরু করলেন- যাতে তার ব্যবহার আরো সহজ, সরল ও উন্নত হয়। এরপর বাইসাইকেলের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হলেন।
তবে যে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের জন্য দুই ভাইয়ের খ্যাতি, প্রকৃতপক্ষে তার চিন্তাভাবনা শুরু হয় ১৮৯৬ সাল থেকে। একজন জার্মান ইঞ্জিনিয়ার অটো লিলিয়েনথাল কয়েক বছর যাবৎ উড়ন্ত যান নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তার তৈরি যান আকাশে উড়লেও তাতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হত। ১৮৯৬ সালে লিলিয়েনথালের আকস্মিক মৃত্যুতে গবেষণার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে লিলিয়েনথালের তৈরি উড়ন্ত যানের নক্সা ভালভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাইট ভাইরা দেখলেন একদিকে যেমন তা অসম্পূর্ণ অন্যদিকে তেমনি নানা ভুলত্রুটিতে ভরা। একে স্বয়ংসম্পন্ন করতে আরো উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োজন।
শুরু হল তাদের অফুরন্ত প্রচেষ্টা। প্রথমে এ যাবৎকাল উড়ন্ত যান সন্বন্ধে যত কাজ ও গবেষণা হয়েছে তার সমস্ত বিবরণ সংগ্রহ করলেন দুই ভাই। প্রতিটি নকশা বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে তারা বুঝতে পারলেন শুধুমাত্র বাতাসের গতিবেগে একে বেশিদূর চালনা করা যাবে না, প্রয়োজন শক্তিচালিত ইঞ্জিনের যা একমাত্র পারবে উড়ন্ত যানকে গতি দিতে।
কিন্তু কেমন হবে সেই ইঞ্জিন, তার প্রকৃতি কিছুতেই নির্ধারণ করতে পারেন না দুই ভাই। ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকলো। প্রতিবারেই সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পরিণত হয়। এক এক সময় হতাশায় ভেঙে পড়েন দুজনে। আবার নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যে কোন মূল্যেই হোক সাফল্য তাদের অর্জন করতেই হবে একদিন।
কিন্তু কিছুদিন পর তারা বুঝতে পারলেন এইভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রকৃত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। এজন্যে প্রয়োজন আরো জ্ঞান অর্জন ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। আর পরিপূর্ণ জ্ঞান না হলে সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জন অসম্ভব।
শুরু হলো ব্যাপক অধ্যায়ন আর অধ্যবসায়। দুই ভাইয়ের মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল স্বপ্ন- এমন যন্ত্র তৈরি করতে হবে যাতে মানুষ শূন্য আকাশে ভেসে যাবে। আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে দুই ভাই ছোট একটি কারখানা তৈরি করলেন। দীর্ঘ এক বছরের সাধনায় তৈরি হল এক বিশাল গ্লাইডার বা উড়ন্ত যান। এতদিন যে ধরণের গ্লাইডার তৈরি হত এটি তারচেয়ে একেবারে স্বতন্ত্র। এই গ্লাইডার বাতাসে ভারসাম্য রেখে সহজেই উড়তে সক্ষম হবে।
গ্লাইডারের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে দুই ভাই তৈরি করলেন দুই পাখাবিশিষ্ট ছোট বিমান। এ বিমানের সামনে ও পেছনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটা ছোট যন্ত্র সংযোজন করা হলো। এর নাম এলিভেটর। মূলত এই এলিভেটরের সাহায্যে পাইলট কোন বিমানকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে। এবার নির্মাণ কাজ সমাপ্তের পর শহর থেকে দূরে এক নির্জনে এ দুই পাখাওয়ালা বিমানকে শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন। বেশ কয়েকবার বিমানকে আকাশে ওড়াবার পর দুই ভাই বুঝতে পারলেন এখনো তাদের উদ্ভাবিত বিমানে কলাকৌশলের কিছু পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
দুই ভাই আবার শুরু করলেন তাদের কর্মতৎপরতা। এবার তাদের মূল লক্ষ্য কিভাবে গ্লাইডারকে শক্তিচালিত করা যায়। বিভিন্ন ইঞ্জিন দিয়ে পরীক্ষা করার পর দেখা গেল একমাত্র পেট্রোল চালিত ছোট ইঞ্জিনই বিমান চালানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে। প্রতি তিন পাউন্ড ওজনের জন্য এক অশ্বশক্তি সম্পন্ন ইঞ্জিন প্রয়োজন। আর বাজারে যে সমস্ত ইঞ্জিন পাওয়া যায় তার প্রতিটিই গাড়ির ব্যবহারের জন্য, বিমান ব্যবহারের অনুপযুক্ত। এজন্যে অরভিল এবং উইলবার রাইট ইঞ্জিন তৈরির কাজে হাত দিলেন। কয়েক মাসের চেষ্টায় তৈরি হল বিমানে ব্যবহারের উপযুক্ত ইঞ্জিন।
প্রত্যাশিত সেই দিনটি এলো। ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯০৩ সাল। শীতের কনকনে দিন। অরভিল এবং উইলবার রাইট তাদের তৈরি বিমান নিয়ে এলেন Kitty Hawk শহরের প্রান্তে। এই প্রথমবারের মতো পৃথিবীর মানুষ বিমানে চেপে মহাশূন্যে পাখির মত ভেসে বেড়াবে- এ সংবাদ আগেই শহরময় প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু কেউই একথা বিশ্বাস করতে পারল না। আকাশে উড়বে বিমান। সমস্ত যন্ত্রপাতি শেষবারের মত পরীক্ষা সমাপ্ত করলেন এবং দুই ভাই নিশ্চিত হলেন তাঁদের তৈরি প্রথম এরোপ্লেন ওড়াবার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়েছে। এরোপ্লেন কথাটা সেসময় সৃষ্টি হয়নি। নাম দেয়া হয়েছিল রাইট ফ্লায়ার।
অল্প অল্প বাতাস বইছিল। অরভিল বিমানের প্রপেলার চালু করলেন। উইলবার বিমানের সঙ্গে বাঁধা দড়িটা খুলে দিলেন। তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে উড়ন্ত যানকে ঠেলতে শুরু করলেন। অবাক হয়ে গেল তাদের ঘিরে থাকা লোকগুলো। তাদের অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়েই সামান্য দূর গিয়েই বাতাসের বুক চিরে শূন্যে উড়ে চলল প্রথম বিমান। কিছুদূর গিয়ে একবার পাক খেল। বেশকিছুক্ষণ এই বিমান চলতে থাকলো। তারপর ধীরে ধীরে মাটিতে নেমে এল। প্রায় বারো সেকেন্ড আকাশে ভেসেছিল রাইট ভাইদের প্রথম এরোপ্লেন। এই বিমান যাত্রাই নতুন যুগের সূচনা করল, যে যুগ গতির যুগ, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটার যুগ।
সহায়ক বই: মাইকেল এইচ হার্ট ও শ্যালেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শত মনীষীর কথা, সম্পাদনা: আহমেদ পারভেজ
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক