ঢাকা: শিল্পী ও কবি-সাহিত্যিকরাই কেবল সুন্দরের পূজারি? অনেক ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে। রাস্তাঘাটের না খেতে পাওয়া হন্যে ভুখাদের মাঝেও কালেভদ্রে দেখা মেলে প্রবল সৌন্দর্যবোধ!
সুন্দরের বন্দনায় ভেতরের ইচ্ছাটাই যে যথেষ্ট সেটা আবারও একবার প্রমাণ করেছেন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে নিত্যদিন টিকে থাকা মানুষদের জনপদ ভোলা সদরের ধৈন্নাতুলাতলী গ্রামের চুন্নু পাটোয়ারী (৩২)।
জীবিকার সন্ধানে শৈশবে বাবা খালেক পাটোয়ারী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় চলে আসে সে। দরিদ্র পরিবারের চুন্নুর পড়াশোনা করা তো দূরে থাক, বিদ্যালয়ের বারান্দায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। শহরের বাড়িতে প্রতিদিনের থাকা-খাওয়ার সংস্থান করতে বাবার সঙ্গে চুন্নুও নার্সারিতে ফুলের চারায় পানি দেয়ার কাজ করে। রাজধানীর বাড্ডা নতুনবাজার এলাকার মন্না মার্কেট এলাকায় স্ব^ল্প টাকার ভাড়া বাসায় বড় হতে থাকে শিশু চুন্নু।
এখন থেকে এক যুগ আগের কথা। অন্যের নার্সারিতে কাজ করতে ভালা লাগে না স্বাধীনচেতা চুন্নুর। চাই এমন কাজ যেখানে নিজেই নিজের বস!
এমন চিন্তায় সাগরপাড়ের দুরন্ত চুন্নু পাটোয়ারীর মাথায় আসলো রাজধানীর লাকরির দোকানে যেসব বাঁশ ও গাছের গুড়ি (শেকড়সহ গাছের গুড়ি) রয়েছে, তা দিয়ে সৌখিন শো-পিস তৈরি করলে কেমন হয়?
ব্যস, তেমনি শুরু হলো চুন্নুর নতুন ব্যবসা। ব্যবসা বললে ভুল হবে, কারণ এর অর্ধেক ব্যবসা বাকিটা মনের খোরাক- জানালো সে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভাস্কর্য বিভাগে কাঠের বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরির জন্য উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও চুন্নুর সে সুযোগ হয়নি। অন্যের শিল্পকর্ম দেখে দেখেই তার এই চর্চা শুরু করে সে।
এই কাজ শুরুর পর চুন্নুর পেরিয়ে গেছে প্রায় এক যুগ সময়। অন্য কিছু না করে এর সঙ্গে লেগে রয়েছে সে। আর্থিকভাবে খুব একটা স্বচ্ছল না হতে পারলেও আক্ষেপ নেই তার। বর্তমানে বারিধারা জি-ব্লকের প্রাচীর ঘেঁষে প্রগতি সরণীর রাস্তার পার্শ্বেই তার শিল্পচর্চা(!) ও ব্যবসায়িক কেন্দ্র। উন্মুক্ত ফুটপাতে হওয়ায় এর জন্য কোনো ভাড়া গুনতে হয় না।
গত রোববার বিকেলে কথা হয় চুন্নু পাটোয়ারীর সঙ্গে।
প্রায় ১০ বছর আগে চুন্নু হাইকোর্টের সামনে থেকে বাঁশের একটি শো-পিস ১২শ টাকায় কিনে আনে। সেটা দেখে দেখে লাকরির দোকান থেকে বাঁশ ও কাঠের গুড়ি সংগ্রহ করে নিজেই শুরু করে শো-পিস তৈরি। প্রথমে দা আর বাটাল দিয়ে কাঠের বাকল ফেলে সেটাকে সাইজ করে ব্যতিক্রমী রূপদান করা হয়। শিরিষ কাগজ দিয়ে ফিনিশিং দেয়ার পর তাতে রঙ ও পালিশ করে তাতে নাটবল্টু দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয় নারকেলের রঙ্গিন করা মালা (খোল)। ব্যস, তৈরি হয়ে গেলো দৃষ্টি নন্দন শিল্পকর্ম, অভিজাতদের ঘরের শোভা বর্ধক সামগ্রী।
চুন্নু জানায়, কেউ ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য, কেউ ফুলের টব কিংবা শিশুদের খেলনা সামগ্রী রাখার জন্য এসব কিনে নেয়। একটি কাঠ বা বাঁশের শো-পিস তৈরিতে দেড়শ’ থেকে তিনশ’ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়।
সে জানায়, কিছু জিনিস এত সুন্দর হয়, এর দাম কেউ দিতে পারবো না। অনেক সময় ধইরা নিখুঁতভাবে এইসব শো-পিস বানাইয়াও উপযুক্ত দাম পাই না। ভাই সবাই সমান না। একটা শো-পিস আড়াইশ’ থাইক্কা দেড়-দুই হাজার ট্যাহা পর্যন্ত বেচি। মাসে ২৫-৩০ হাজার ট্যাহা বেচবার পারি। অভাবের জন্য অনেক সময় কম দামেও দিয়া দেই, কি করমু। বিয়া করছি-- দুইডা পুলাও আছে, পুলা দুইডারে স্কুলেও দিছি।
চুন্নু আক্ষেপ করে জানায়, গতকাইল আড়াই মণ ওজনের খুব সুন্দর একটা টি-টেবিল মাত্র আড়াই হাজার ট্যাহায় বেইচ্যা দিছি। কম কইরা অইলেও এইডার দাম আছিল পাঁচ হাজার ট্যাহা।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে সে জানায়, অনেক বড় চিন্তা কইরা লাভ নাই। সামর্থ্যও তো থাহা লাগবো। তবে একটা দোকান দিবার চাই। কারণ রাস্তায় দোকান দিছি বৈলা কেউ কেউ গালি দেয়, কয় রাস্তা দখল লইছে শালায়-- তহন খারাপ লাগে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, ০৯ আগস্ট, ২০১২
এআই/সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর