ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মোবাইল ফোনে জন্ম নিবন্ধন!

রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৩৫, আগস্ট ১১, ২০১২
মোবাইল ফোনে জন্ম নিবন্ধন!

ঢাকা: সেনেগালে মোবাইল ফোন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নবাগত শিশুর জন্ম নিবন্ধন হচ্ছে খুব সহজেই। এ পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনের টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে সদ্যজাত শিশুর বিস্তারিত বিবরণ কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে জন্ম সনদ পাওয়া যাচ্ছে।



সেনেগালের আইন অনযায়ী জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক না হলেও বিদ্যালয়ে ভর্তি এবং প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে জন্ম নিবন্ধন সনদের প্রয়োজন পড়ে।

সেনেগালের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে জন্ম নিবন্ধন কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াতের অসুবিধা ছাড়াও দরিদ্রতা, অজ্ঞতা ও অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে অবহেলাই জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে।

তবে সেনেগালে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এগিয়ে আসে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এইড এট অ্যাকশন। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে প্রত্যন্ত কোলদায় পরীক্ষামূলকভাবে মোবাইল টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে শিশুদের জন্ম নিবন্ধন কর্মসূচি হাতে নেয় তারা।

জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে মোবাইলে টেক্সট মেসেজ পদ্ধতির প্রয়োগ শুরুতেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করে। গত বছর সেপ্টেম্বরে কর্মসূচি শুরুর তিন মাসের মধ্যে ২০টি জন্ম নিবন্ধন হয় কোলদায়। ২০০৩ সালের পর যা ছিল এলাকায় সর্বোচ্চ।

এ প্রসঙ্গে কোলদার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের উপপ্রধান ইয়া কানদে বলেন, “দেখুন ওই মাঠে কাজ করা গ্রামীণ কৃষকের হাতে বেশিরভাগ সময়ই শিশুর জন্মের পর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা করার মতো সামান্য অর্থও থাকে না। সাধারণত জন্মের পরই শিশুর একটা নাম রেখে সে আবারও তার ক্ষেতখামারে ফিরে যায়। শিশুর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার খুব একটা সুযোগ থাকে না তাদের। ”

কর্মসূচির আওতায় প্রথমে কোলদার গ্রামপ্রধানদের হাতে একটি করে জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় অ্যাপ্লিকেশনযুক্ত মোবাইল ফোন সরবরাহ করা হয়। যারা জন্ম নিবন্ধনের জন্য রেজিস্ট্রেশন সেন্টারে যেতে পারেন না তারা শিশুদের জন্মের পর তাদের নিজ নিজ গ্রামপ্রধানদের প্রয়োজনীয় তথ্য জানায়। গ্রামপ্রধান পরবর্তীতে জন্ম নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠিয়ে দেন।

সাধারণত সেনেগালে জন্ম নিবন্ধন সনদের জন্য খরচ পড়ে ৩০০ সেনেগালিজ ফ্রাঁ বা ৬০ মার্কিন সেন্ট (১০০ সেন্টে এক ডলার)। অথচ নতুন পদ্ধতিতে জন্ম নিবন্ধনের জন্য টেক্সট মেসেজ পাঠাতে খরচ হয় মাত্র ১০ সেনেগালিজ ফ্রাঁ।

এ ব্যাপারে এইড এট অ্যাকশনের মুখপাত্র অ্যাগনেস ফিসটার বলেন, জন্ম নিবন্ধনের এ পদ্ধতি তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তথ্যগুলো একটি কেন্দ্রীয় সার্ভারে রক্ষিত থাকে। ফলে পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষ সহজেই যে কোনো সময় তা অনুসরণ করতে পারে।

টেক্সট মেসেজ পদ্ধতিতে জন্ম নিবন্ধনের সফলতার ব্যাপারে অনেকেই বলছেন, “এ পদ্ধতি দূরত্ব, সময় এবং অর্থ বাঁচিয়ে দিচ্ছে। জন্ম নিবন্ধক অফিস থেকে দূরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামপ্রধানেরা এখন শিশুর জন্মের অল্প সময়ের মধ্যেই জন্ম নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারছে। ফলে যে সব দরিদ্র অভিভাবকদের পক্ষে ক্ষেতখামার ছেড়ে দূরে যাওয়া অসম্ভব তারা খুব সহজেই এর সুযোগ নিতে পারছে। ”

সম্প্রতি ইউনিসেফের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের কমপক্ষে ২০টি দেশে উচ্চ খরচের কারণে শিশুদের জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবকদের মধ্যে অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশ্বে সাব সাহারার দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি অনিবন্ধিত শিশু রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সেনেগালের একজন রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তা আলিউ কামারা বলেন, “পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। অনেক জন্মই এখন নিবন্ধন করা হচ্ছে। গত দুই মে ও জুন মাসে কোলদা অঞ্চলে ৮০ শতাংশ শিশুর জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে।

সদ্য জন্মনিবন্ধিত একটি শিশুর মা সেনে স্যালি নতুন কর্মসূচির সুবিধা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “আমি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমার শিশুর জন্ম নিবন্ধন করেছি। কারণ এ পদ্ধতি খুব সহজ। ”

কোলদা সেনেগালের সবচেয়ে দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানকার ৬০ শতাংশ অধিবাসীই কখনো শিক্ষার আলো পায়নি। বেঁচে থাকার জন্য তাদের একমাত্র অবলম্বন কৃষিকাজ। প্রধানত ধান, বজরা ও বাদাম চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করে তারা।

দারিদ্র আর অভিভাবকদের অসচেতনায় এ এলাকার শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হারও তাই অনেক বেশি। এ ব্যাপারে কোলদা অঞ্চলে মোবাইলের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধন কর্মসূচির দায়িত্বপ্রাপ্ত ওমার বালদে বলেন, “প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার জন্য শিশুরা বিদ্যালয়ে যায় ঠিকই, তবে তা চালিয়ে যেতে পারে না তারা। কারণ জন্ম নিবন্ধন সনদের অভাবে শিশুরা পরবর্তীতে আর ষষ্ঠ গ্রেডের সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন জানাতে পারে না। মূলত সেখান থেকেই ঝরে পরে বেশিরভাগ শিশু। ”

এছাড়া সেনেগালে জন্ম নিবন্ধন প্রাপ্তির অন্যান্য কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে সেনেগালের ইউনিসেফের সহকারী প্রধান মোহাম্মেদ সালা বলেন, “কোলদার ৬০ ভাগ শিশুর জন্মই অনিবন্ধিত। স্থানীয় গ্রাম প্রধানরা সাধারণত জন্ম নিবন্ধনের তথ্য খাতায় লিখে রাখে, পরবর্তীতে এর বিবরণ সরকারি নিবন্ধকদের কাছে পাঠায়। তবে খাতা ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত সাধারণত জন্ম নিবন্ধন অফিসে সরবরাহ করেন না তারা। অভিভাবকদের তাই পরে আবারও ১২ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে জন্মের স্বীকৃতি নিতে হয়। তাই অভিভাবকরা সংগত কারণেই পরবর্তীতে আর শিশুদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য খুব একটা উৎসাহী হন না।

জন্ম নিবন্ধনের অভাবে শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া প্রসঙ্গে কোলদা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক ওসমানে কলি জানান, তার বিদ্যালয়ের নার্সারি এবং প্রি-স্কুল শ্রেণির অধিকাংশ শিশুরই জন্ম নিবন্ধন নেই। নার্সারিতে সব শিশুই জন্ম নিবন্ধন ছাড়া ভর্তি হতে পারে কিন্তু জন্ম নিবন্ধন না থাকায় তারা পরে আর ষষ্ঠ গ্রেডের সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে না। অনেক অভিভাবকই মনে করেন জন্ম নিবন্ধন সনদের বিকল্প হিসেবে টিকাদান কর্মসূচির কার্ড ব্যবহার করা যাবে। আমাদের বিদ্যালয়ে নার্সারি ও প্রি-স্কুল শ্রেণির ১৭২ শিশুর মধ্যে মাত্র ৫০ জনের জন্ম নিবন্ধন আছে।

প্রাথমিক সফলতা লাভের পর এখন বিশেষজ্ঞরা বিস্তৃত আঙ্গিকে এ কর্মসূচির সফলতা নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে আশার কথা হলো সেনেগালের কর্তৃপক্ষও মোবাইলফোনে এসএমএস পদ্ধতিতে জন্ম নিবন্ধনের সফলতা অনুধাবনের পর এখন এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে কাজ করছেন বলে জানান ফিসটার।

পাইলট প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের পর এখন দ্বিতীয় ধাপে দক্ষিণ ও মধ্য সেনেগালের কোলদা এবং দিয়ারবেল এলাকার ৫০০ গ্রামকে এ কর্মসূচির আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১২

সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।