আমার স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি। মাদ্রাসায় পড়েছি।
বিশেষ করে, ইতিহাস বিভাগের যে সিলেবাস, তারিখ, সাল- এসব নাম মুখস্থ করা, এই ইতিহাসচর্চায় আমার কোনো দিনই আগ্রহ ছিল না। আমার মনে আছে, যেসব সিলেবাস আমি লিখতাম, তা ছিল অনেক বিশ্লেষণধর্মী। আমার শিক্ষকেরা সব সময় বলতেন, ‘এটা তো তোমাকে বলা হয়নি। ’ তথ্যের চেয়ে তথ্যের ব্যাখ্যাই আমাকে সবসময় আগ্রহী করেছে। সে জন্য তথাকথিত প্রথাসিদ্ধ যে ইতিহাসচর্চা, সেটা আমাকে কখনোই আকৃষ্ট করেনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পড়তে গিয়ে বুঝতে পারলাম, প্রথাগত একাডেমিক যে ইতিহাসচর্চা, তা খুবই তথ্য ও সংখ্যাভিত্তিক। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমি বেশ কিছু ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। মুসতাসীর মামুন আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম না। তারপরও প্রশ্রয় দিতেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম আমার শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আহমদ শরীফ। আমি তার খুব ভক্ত ছিলাম।
তখন ‘লেখক শিবির’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এর সঙ্গে জড়িত হয়ে যায় আমার সব সৃজনশীল মেধাবী বন্ধু। শামীম আখতার, পিয়াস করিম, আফসার আজিজ, আবরার চৌধুরী, কামরুল হক মিঠু- এমন আরও অনেকেই। যা হোক, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে লেখকদের একটি জোটের মতো হচ্ছিল, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হই আমিও। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে আহমদ ছফার সান্নিধ্য। তিনি বলে যাচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আর আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি। মাঝেমধ্যে এমনও হতো যে, চার-পাঁচ ঘন্টা কথা বলে যাচ্ছেন লাইব্রেরি চত্বরে বসে। অথচ আমরা সবাই অনড় হয়ে বসে আছি। এমন আরও অনেকেই আমাদের অনুপ্রাণিত করতেন। যেমন, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু মাহমুদও আমাদের প্রিয় ছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল আহমদ ছফার সঙ্গে। কারণ, ছফা ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের একটা সুবিধা ছিল। অন্যদের সঙ্গে আমরা তেমন তর্ক করতে পারতাম না।
আমার মনে আছে, আমি ছফা ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত যেকোনো বিষয় নিয়ে তর্ক করতাম। খুব জেনে-বুঝে যে করতাম, এমন নয়। তারপরও হুজ্জুতি করে হলেও তর্ক করার জন্য তর্ক করা যেত। উনি পছন্দ করতেন না, কিন্তু সহ্য করতেন; এবং কিছুটা হলেও এগুলো প্রশ্রয় দিতেন। একটি ইশতেহারের কথা মনে আছে। সমসাময়িক শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে যে প্রবণতা অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতা- এ বিষয়ে আমরা প্রায় ১৪ জন লেখক, এর মধ্যে সলিমুল্লাহ খান প্রধান দায়িত্ব পালন করেছিলেন লেখাটি তৈরির ক্ষেত্রে। এবং সঙ্গে ছিলেন নুরুল হুদা থেকে অসীম সাহা অনেকেই। আমরা ১৪ জন স্বাক্ষর করেছিলাম, আমি লেখক না হয়েও স্বাক্ষর করেছিলাম। ইশতেহারটির ষাটের দশকের অনেক বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে বেশ আক্রমণাত্মক সমালোচনা ছিল। ছাপার আগে আমরা ইশতেহারটি পড়িয়ে নিয়েছিলাম আহমদ ছফাকে। ওটা পড়ে তিনি আমাদের গাল দিয়েছিলেন। একটা কথা বলেছিলাম, ‘তোমরা এখন উঠতি বয়সী লেখালেখির ক্ষেত্রে, এ সময় অগ্রজদের এভাবে খেপিয়ে তুললে তোমাদের ক্ষতি হবে। ’ তখন আমি কিছুটা বেয়াদবের মতো বলেছিলাম, ‘উই ডোন্ট কেয়ার। ’ তখন তিনি আমাকে সাবধান করে বলেছিলেন, ‘এই ছেলে, তুমি বিপদে পড়বে। ’
অসত্য না থাকলেও একটু অতিশয়োক্তি ছিল আমাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে, বয়স হওয়ার পর আমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই তখন বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ে কাজ করত। আমি ছিলাম ফিল্ম নিয়ে। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ‘রাখাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান করল। খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল আমাদের। ওদিকে শিশির ভট্ট্রাচার্য্র, ঢালী আল মামুন, রুহুল আমিন কাজল, হাবিবুর রহমান, ওয়াকিলুর রহমান, আলিম হোসেন নোটন- সবাই তখন আর্ট কলেজের ছাত্র। ওই সময়টায় একটা ব্যাপার ছিল পারস্পরিক আদান-প্রদান। আমি আর্ট কলেজে এত নিয়মিত যেতাম যে অনেক ছাত্রছাত্রী আমাকে আর্ট কলেজে ভাবত। আর্ট কলেজের ছাত্রাবাসের ১২ নম্বর রুমটায় থাকত শিশির। ওখানে আমার অনেক রাত কেটেছে। ভিজ্যুয়াল আর্ট নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল প্রবল। এ জন্যই সুলতানকে নিয়ে ছবি করা। আমার প্রথম ছবির বেলায় আহমদ ছফার একটা বিরাট অবদান ছিল। তেমনি সংগীতের প্রতিও আমার প্রচুর আগ্রহ ছিল এবং এর সঙ্গে জড়িত অনেক বন্ধুও ছিল। পুলক গুপ্ত, সঞ্জীব দে, সুমন, হ্যাপী আখন্দ, মাকসুদুল হক- এমন আরও অনেকে। সহপাঠীদের সঙ্গে আমার খুব একটা সময় কাটেনি, এটা আমার ব্যর্থতা। আমার যতটা না ইতিহাস বিভাগে কেটেছে, তার চেয়ে বেশি কেটেছে ইংরেজি ও স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে। বুয়েটের বাইরে যে কজন অনাহূত অবৈধ ছাত্র থাকত, তাদের একটা ছিলম, ‘কুয়াশা’। এটা কেন, আমি জানি না। তবে আমিও ‘কুয়াশা’ ছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এই যে চার-পাঁচ বছর আমার কেটেছে, এর পুরোটাই আমার কাজে লেগেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যে ধরনের প্রস্তুতির দরকার, প্রকান্তরে তা-ই ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তোলা জলে আমার স্নান নয়। ’ আমার ওই বিশিষ্টতা নেই যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করব, তবে আমি ঠিক উল্টো বলব। আমার যে শিক্ষা-দীক্ষা, তার পুরোটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, কিন্তু ক্লাসের ভেতর নয়, ক্লাসের বাইরের ক্যাম্পাসে। কারণ, সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডাগুলো খুবই সৃজনশীল ও শিক্ষামূলক হতো। এখন কেমন হয়, জানি না। আমার মনে হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দিনের আড্ডাও আমার বৃথা গেছে। আমার মাদ্রাসার জীবন ছিল খুবই নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলিত- ভোর চারটা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সবকিছু পরিপাটি ও সাজানো। এ কারণেই কি না জানি না, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে সময়টা খুবই বাউন্ডুলেপনা ও বোহেমিপনার ভেতর দিয়ে কেটেছে। যে ধরনের কাপরচোপড় আমি পরতাম, জানি না এখনকার ছাত্রছাত্রীরা সে সাহস করবে কি না। আমি একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে এসেছি। আমার চাচাদের ও চাচাতো ভাইবোনের আর্থিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আমার সময় কেটেছে। থাকতামও চাচাতো ভাইদের সঙ্গে। দারিদ্র্য ও অর্থাভাবে কেটেছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়। এক বেলা খেতে পারিনি- এমন অনেক সময় হয়েছে, কিন্তু সেটা আমল করিনি। কোনো না কোনোভাবে ঠিকই চলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার প্রাপ্তি অনেক। এখনো কখনো যদি যাই, খুবই নস্টালজিক অনুভূতি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখি আমি। সত্তরের দশকের পটভূমিতে ওই সময় যে হিপ্পি টাইপ লম্বা চুল, বেলবটম প্যান্ট, এমনই লুক-এ। অর্থাৎ ওই সময়ের জীবনকে ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশটা সিনেমায় একটা গল্পের মধ্যে দিয়ে বলা। কারণ, এরাই তো সিনেমার বিরাট দর্শক। এদের নিজেদের জীবন তো এরা নিজেরা দেখতে পায় না।
[তারেক মাসুদের বিভিন্ন লেখা নিয়ে প্রকাশিত বই ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ বই থেকে লেখাটি নেওয়া হয়েছে। ]
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ১২, ২০১২