অদ্ভুত সারল্যের এক অনুজপ্রতিম বন্ধু আছে আমার। দেখা-সাক্ষাতের শেষ পালাটা ছিলো সম্ভবতঃ ১৯৯৮ সালে হংকংয়ে।
খুব ছোটবেলায় হারিয়েছেন জন্মদাতা পিতাকে। বড় ভাইদের পিতৃজ্ঞান করা বিনয়ী মানিক সবাইকে আপন করে নেবার দক্ষতা ও নৈপুন্যে অ-প্রতিদ্বন্দী। ব্যক্তিগত জীবনে অসম্ভব দেশপ্রেমী। মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্ম হলেও চেতনা-চৈতন্যে মানিক জ্বলজ্যান্ত এক ‘একাত্তর’। আপাদমস্তক এক মুক্তিযোদ্ধা। মানিকের জীবনের দুটি বড় দুঃখ ও ক্ষোভ। এক নিজের পিতাকে বোঝার আগেই হারানো। আর জাতির পিতাকে জন্মের আগেই খোয়ানো। তিনি নিজেকে বঙ্গবন্ধুর একজন সন্তানই ভাবেন। মানিক দুই পিতাকে হারানোর যাতনায় কাতর।
মিনার মাহমুদের মৃত্যুর শোকে কাতর মানিক রহমান দীর্ঘক্ষণ কাঁদলেন ফোনে। নিজের ভাইদের অকুণ্ঠ স্নেহ আর বাবার স্পর্শহীন জীবনের কথা বললেন। কথায় কথায় এলো মানিকের অন্য পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ। মানিক দুঃখকাতর কণ্ঠে জানালেন, নিজের অগ্রজদের মধ্যে তিনি নিজ জন্মদাতার ছবি খোঁজেন। আর বঙ্গবন্ধুর ছবি ও ছায়া খুঁজেন বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের মধ্যে। বিশেষতঃ বড় কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে। হাসিনার সাফল্য-ব্যর্থতায় তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি খোঁজেন। বঙ্গবন্ধুর সার্বিক ইমেজ রক্ষা যেন হাসিনার একক দায়িত্ব।
যতবার আমি নিজে ঢাকা ছাড়ি প্লেনে ততবার ধন্যবাদ জানাই বঙ্গবন্ধুর। কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে আসে। এই মহান মানুষটি যদি স্বাধীনতায় বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ না-করতেন, তাহলে আমার মতো আরো অনেকে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের করনিক কিংবা পিআইএ’র নিম্ন পদস্থ কর্মকর্তার জীবন-জীবিকায় থাকতাম। উর্দু-বাংলা মেশানো এক জগা-খিচুড়ি ভাষায় বাতচিৎ করতাম, যেভাবে হিন্দি উচ্চারণে বিকৃত বাংলা বলেন কলকাতার মানুষ। জানি, অনেকে এই অপ্রিয় সত্যের বিরোধিতায় মাতবেন। কিন্তু ১৯৭১-৭২ সালের ইসলামাবাদের স্কুল জীবনের বাস্তবতায় এটাই অপ্রিয় সত্য। কৈশোরের বন্ধু বিখ্যাত ক্রিকেটার জালাল ইউনূসের ফাস্ট বোলিংকে ভয় পেতোনা এমন ক্রিকেটার পাক রাজধানী ইসলামাবাদে ছিলোনা। অনায়াসে পাক যুব ক্রিকেট দলে ঠাঁই পাবার কথা জালালের। পাননি বাঙালি হবার অপরাধে। স্কুলে-সমাজে বাঙালি ছিল নমশূদ্র জাতীয় শ্রেণী। বাঙ্গালিদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতে দেখিনি। আমরা বাঙালিরা ছিলাম প্রজার তাচ্ছিল্যে।
আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেই। সমর্থকও নই। আবার বিরোধীও নই। আওয়ামী লীগের প্রতি আমার একমাত্র দূর্বলতা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মানিকের মতো আমিও নিজের পিতা ভাবি। বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের মধ্যে আমিও খুঁজি বঙ্গবন্ধুর ছায়া। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই মহান নেতার প্রতি সুবিচার করছেন না তার সন্তানেরা। যে মানুষটি পুরো দেশটির পিতা, তাকে একটি পরিবারের পিতার আদলে উপস্থাপনের বিভিন্ন প্রয়াস দেখি। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর সমার্থক। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক আর লাল-সবুজ পতাকা একই মাত্রায়। যখন দেখি জাতির পিতার মান বাড়ানোর নামে মান ক্ষুন্ন করার অপপ্রয়াস, তখন দুঃখ লাগে। চেনা বামনের কোনো পৈতা লাগেনা। জাতির জনকের নামে বিশ্ববিদ্যালয়, সেতু কিংবা বড় দালানের নামকরণ অকারণ ঠেকে। দেশের প্রতিটি মুদ্রায় কেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি থাকবে? যদি রাখতেই হবে তাহলে বড়জোর দেশের সর্বোচ্চ মুদ্রা ১ হাজার টাকায় থাকতে পারেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু দু’টাকার নোটে?
আরো বিরক্তিকর ঠেকে বঙ্গবন্ধুর নামে গড়ে ওঠা মৌসুমী সংগঠনগুলো যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ কী জানে না, বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা অস্পর্শযোগ্য সম্মানের? বারবার বঙ্গবন্ধুর মতো মহান মানুষটিকে কেন টেনে আনা হচ্ছে মর্ত্যের ধূলিময় মাটিতে? বঙ্গবন্ধু কী তবে এক ব্র্যান্ডের নাম?
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার