ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

নান্টু মিয়ার ঈদ আনন্দের পালাবদল

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:১৫, আগস্ট ১৯, ২০১২
নান্টু মিয়ার ঈদ আনন্দের পালাবদল

রামগঞ্জ (লক্ষীপুর) থেকে: বেড়ার ঘরের সামনে টিনের চালের নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছে নান্টু মিয়া। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে।

ঠোঁটে বিড় বিড় করে আল্লাহ আল্লাহ বলতে থাকে ৭ বছরের নান্টু। দোয়া করে এক সময় বৃষ্টি থামবে, রোদ উঠবে। আবার কখনো কখনো উল্টো করে ১০০ থেকে ১ পর্যন্ত গুনতে থাকে। আবার চোখ বন্ধ করে রাখে। ইস চোখ খুললেই যদি দেখতো আর বৃষ্টি নেই। বেরসিক বৃষ্টি, কোনো দোয়াতেই কাজ হয় না।

এর আগের বছরের রোজার ঈদের কথা ভেবে হাসি আসে নান্টুর। আহ্ কি মজাই না হয়েছিল সেবার! রাতুল, আশিক, রাফিসহ মোট ৬ জন গিয়েছিল পদ্মাবাজারের ঈদগাহ মাঠে। পকেটেও টাকা ছিল অনেক, সবমিলিয়ে ৫০ টাকার ওপর। প্লাস্টিকের খেলনা গাড়িটা কিনে ঈদের পূর্ণ আনন্দ লাভ করেছিল সে। কলা গাছের আশ দিয়ে গাড়ির সামনে বেঁধে সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে পড়াশোনা ছাড়া কয়েকটা দিন ভালই কাটিয়েছিল নান্টু।

গত ঈদের কথা মনে করতেই বুক ভেঙে কান্না আসে নান্টুর, চোখ ছলছল করে ওঠে। ইচ্ছে করছে পুরো পৃথিবীটার উপর একটি ছাতা ধরুক কেউ। এবার কি টাকা উঠবেই না? এবার ভেবেছিল সেলামির অংক অন্তত ৮০ টাকা ছাড়াবে।

নান্টুর ঈদের সেলামির উৎসগুলো ছিল নির্দিষ্ট। বাবার থেকে ২০ টাকা, নানুর বাড়ি থেকে ২০ টাকা, দাদীর কাছ থেকে ১০ বা ২০ টাকা। তবে এবার ভেবেছিল বড় খালার বাড়িতে গিয়ে হিসেবের অংকটা আরেকটু বড় করবে।

ঈদের নামাজ পড়া হলো না, এটা নিয়ে একটু খুশিই বরং নান্টু। গতবারের আগেরবার বড় মসজিদে হুজুর এতো দীর্ঘ মোনাজাত ধরেছিল যে পরে সবার পরে যেতে হয়েছিল পদ্মা ঈদগাহ মাঠে। সেসময় কাঠের লাঠি দিয়ে বানানো হেলিকপ্টারটি আর কেনা হয়নি নান্টুর।

বড় মসজিদের হুজুরের উপর সে ক্ষোভ এখনো রয়ে গেছে তার। পরে অবশ্য ‘বুশ-সাদ্দামের ফাইট’ খেলনাটি কিনতে পেরেছিল। প্লাস্টিকের একটি কাঠির ওপর দুই বক্সার। নিচের আংটায় চাপ দিলে বুশ আর সাদ্দাম একে অপরকে ঘুষি মারে। আবার আংটা ছেড়ে দিলে দূরে চলে যায় তারা।

দুই টাকা দিয়ে  স্বর্ণের চেইন কিনে গলায় পরে বাড়ি ফিরেছিল নান্টু। হয়তো বিকেলেই ছিড়ে গিয়েছিল সেই চেইন। লাল পোটকা দিয়ে দিয়ে বানানো বাঁশিটা সারাদিনের অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি। ফেটে গিয়েছিল।

গত কয়েকদিন ধরেই নান্টু ঠিক করে রেখেছে সাত্তারের দোকানে ঝোলানো বড় প্লাস্টিকের গাড়িটার মালিক হবে। চাকাগুলো বেশ বড় আছে। মাটির রাস্তায় চলতে ভালই হবে। আর কলা গাছের আঁশ ধরে দৌড় দিলেও উল্টে পড়বে না আশা করা যায়। গতবারের ছোট লাল প্লাস্টিকের কারটি আসল মারুতি ছিল না। দৌড় দিলেই উল্টে যেত। শেষে তো একটা চাকা খুলেই গিয়েছিল। এবার আর এ ভুল নয়।

এবারের ঈদে নান্টুর জামা-কাপড় গতবারের তুলনায় ভালো। ঈদের দিন সকালে ভোর রাতে এসে পৌঁছেছেন বাবা। এখনো দেখা হয়নি। সকালে সেমাই খেতে খেতে শুনেছে বাবা নামাজ পড়তে গেছে। নান্টুর জন্যে একটা লাল পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট আর স্যান্ডেল নিয়ে এসেছে বাবা। স্যান্ডেলটা একটু ছোট হলেও খারাপ না। আন্দাজের কেনা আর কতটুকু নিখুঁত হবে!

কখনোই নান্টুর জানতে ইচ্ছে করেনি বাবা-মা কী কিনেছে ঈদে। মাকে কখনো ঈদে নতুন শাড়ি পড়তে দেখেছে কিনা ওসব এখন ভাবার সময় নেই তার। দুনিয়ার সব আনন্দই তার চাই। দুঃখের ভাগ নিতে চায় না।

নান্টুর চোখে আবারো পানি আসে। বৃষ্টি বাড়তে থাকে। আর দোচালার নিচে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। বড় বড় বৃষ্টির ফোটা।

মুখ ভারি করে ঘরে ঢুকে যায় নান্টু।

যৌবনে নান্টু মিয়ার ঈদ
২০ বছর পরে নান্টু দাঁড়িয়ে আছে সেই বাসার সামনেই। তবে বেড়ার ঘরের  জায়গায় এখন বিল্ডিং উঠেছে। নান্টুর বাবার বয়স ষাট পেরিয়েছে। মার চুল অর্ধেকের বেশি সাদা।

এখন আর পদ্মা বাজারে যেতে ইচ্ছে করে না। মনে মনে ভাবে বৃষ্টি আসলে ভালোই হবে। কোথাও না যাওয়ার অজুহাত দেওয়া যাবে। তবে ঈদের নামাজের পর বৃষ্টি হলে ভালো। নামাজ পড়তে গেলে গ্রামের সকলের সঙ্গে একটু করে দেখা হবে।

বৃষ্টির আরেকটা সুফল হচ্ছে, বিচ্ছু বাহিনী আসতে পারবে না সেলামি চাওয়ার জন্যে। তারপরও অনেককেই দিতে হবে। গত কয়েকবছর ধরে এ সেলামি বাবদ খরচ হয়ে যাচ্ছে প্রায় দু’হাজার টাকা। দিন পরিবর্তন হয়েছে, যে বয়সে নান্টু সেলামি পেত ৫০ টাকা, এখনকার পিচ্চিরা পাচ্ছে ৫০০ থেকে হাজার টাকা।

এবারের ঈদে নিজের জন্যে নতুন কোন কাপড়-চোপড় কেনা হয়নি নান্টুর। নষ্ট হয়ে পড়লেও পুরনো স্যান্ডেলটা ঢাকা থেকে কালি করে আনা হয়েছে। বন্ধুর থেকে ধার করা পাঞ্জাবি আর পুরনো জিন্সের প্যান্টটা ইস্ত্রি করে এনেছে, কোনো চিন্তা নেই।

এখন আর নিজের নতুন জামা-কাপড়ে ঈদ জমে না নান্টু মিয়ার। অফিসে বেতন পেয়ে নিজের বাবা-মার জন্যে নতুন পাঞ্জাবি আর শাড়ি কিনেছে। নান্টুর বাবা-মা এর আগে কোনদিন এতো দামী কাপড় পরেননি।

বৃষ্টি থামবে না বলে মনে হচ্ছে। বৃষ্টি মলিন করতে পারেনি নান্টুর বাবা-মার মুখের হাসি।

নিশ্চিন্ত মনে ঘরের ভেতর ঢুকে যায় নান্টু।

মধ্যবয়সী নান্টুর মিয়ার ঈদ
পৃথিবীতে সবচেয়ে বিরক্তিকর ইনিংস হলো মেয়ে মানুষের সঙ্গে মার্কেটে যাওয়া। এই ইনিংস শেষ হতে চায় না। টেস্ট খেলায় যেমন ৫ ওভারের ৩০ বলে ব্যাটসম্যান রান করে ১টি, তেমনি মেয়ে মানুষ ৫ দোকানের ৫৫টি কাপড় নামিয়ে শেষে দোকানদারকে বলেন, আরেকটু ঘুরে আসি। নান্টু ঘুরছে বউয়ের পেছনে শপিং ব্যাগ হাতে।

১০ বছর আগে শুধু বাবা-মার জন্যে শপিং করতে হতো, এখন যোগ হয়েছে বৌ আর দুই সন্তান। এছাড়াও নিজের বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ির কিছু বুড়িও রয়েছে।

নান্টু ৬ বছরের ছেলের জন্যে প্যান্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি, জুতো সব কিনেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সব কিছুই নিউমার্কেটে জুটেছে ৫ হাজার টাকায়। ৩ বছরের মেয়ের জন্যে এক হাজার টাকায় কাভার দেওয়া যাবে। এখনো ছেলেটার মতো পাজি হয়ে উঠেনি, প্রতিবাদ করতে পারবে না।

মেয়েকে কোলে নিয়ে বৌ আর ছেলের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায় নান্টু। হাতে শপিং ব্যাগ। এদের মুখে হাসি ফোটানোই এখন তার ঈদ উৎসব।

রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবি নান্টু মিয়া।

বৃদ্ধ নান্টু মিয়ার ঈদ
সকালে ঈদের নামাজ পড়ে উঠানে এসে দাঁড়ায় বৃদ্ধ। ২২ বছর আগে যে মেয়েটির পেছন পেছন মার্কেটে ঘুরতো বৃদ্ধ, সময়ের আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে সে। ছেলের সংসার আমেরিকা, কখনো আর ফিরে আসবে বলে মনে হয় না বৃদ্ধের।

সামনে মাধ্যমিক স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের পরীক্ষা, তাই ঈদ ঢাকাতেই করছে মেয়ে।

চার বছর ধরে এই একই পাঞ্জাবি গায়ে ঈদ করছেন বৃদ্ধ। মানুষের বাসা থেকে যেসব সেমাই পাঠায় সেগুলোতে মন ভরে না তার।

আজও ঈদের দিন বৃষ্টি হবে, আকাশ থেকে ভারি বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করেছে। শূন্য ঘরের দিকে এগিয়ে যায় নান্টু মিয়া।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১২
এমএন/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।