ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

‘৩০ বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা ভাই...’

মফিজুল সাদিক ও জুলফিকার কানন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৩৮, আগস্ট ২১, ২০১২
‘৩০ বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা ভাই...’

মেহেরপুর সীমান্ত থেকে: ভাই তুমি কেমন আছো, মা কেমন আছে বাড়ির সবাই কেমন আছে? আমার কোনো কিছুর অভাব নেই ভাই। অভাব শুধু তোমাদের সঙ্গে দেখা না হবার।

বাবা কেমন আছে? ভাই মা আজ ১০ বছর মারা গেছেন। তাই, তোমাকে দেখাতে পারিনি ভাই।

এভাবেই ৩০ বছর পরে দেখা হবার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবার অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন ভারতের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার শিশা গ্রাম থেকে আসা আশরাফ সিদ্দিকি। বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার ঝাউবাড়িয়া গ্রামে বসবাসরত ছোট ভাই মো: আমিরুল ইসলামের সঙ্গে মঙ্গলবার দেখা হওয়ার সময় কান্না ও আবেগে আপ্লুত হয়ে যান তিনি।

দুই ভাইয়ের চোখের পানি ও আকাশ থেকে ঝরে পড়া মুষলধারের বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে যায় সীমান্তে। চারদিকে আরো মানুষের কান্নার আহজারিতে গোটা পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভারত সীমান্ত খুলে দিয়েছিল দুই দিনের জন্যে।

সীমান্ত খোলা থাকে সোমবার ঈদের দিন ও মঙ্গলবার ঈদের পরদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।

বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা জুড়ে সেই চিত্র ধরা পড়ে। যেমনটি দেখা গেছে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার রংমহল সীমান্ত এবং ভারতের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার ধাড়া সীমান্তে।

এখানে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রতিকূল ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে না দেখা স্বজনরা।

মো: আশরাফ সিদ্দিকি বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘১৯৪৯ সালে বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে আমি ভারতে থেকে যাই। ছোট ভাই বাংলাদেশে চলে যান। তারপর মাঝে মাঝে দেখা হলেও এবার ৩০ বছর পর দেখা হলো ছোট ভাইটির সঙ্গে। ’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘এটাই আমার মনে হয় শেষ দেখা আর হয়তো আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না। ’’

মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সীমান্তে অনেকে স্বজনের জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছেন, কখন স্বজনের সঙ্গে দেখা হবে। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অব ইন্ডিয়ার(বিএসএফ) এর সদস্যরা ৮ জন ১০ জন করে গেট খুলে স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছেন।

আবার অনেকে তারকাটার বেড়ার এপারে ওপার থেকে একে অপরকে দেখে কান্নাকাটি করছেন।

নদীয়া জেলার করিমপুর থানার গোপালি গ্রাম থেকে আসা হাসেম শেখ বাংলাদেশ দেশের নাগরিক কাসেম শেখকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তারকাটার এপার থেকে ডাকাডাকি করতে থাকেন, ‘‘ভাই তুমি আমাকে চিনতে পারছো, ভাই?’’

এর পর গেট খুলে দেওয়ার পর শুরু হয় দুই ভাইয়ের কান্নাকাটি। দীর্ঘ ২০ বছর পর দেখা হওয়ায় মুখে কোনো কথা নেই। দুই চোখ বেয়ে শুধু ঝরছে পানি।

একে অপরকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরছেন। বিএসএফের নির্দেশে আবার তারা যার যার নিজের ঠিকানায় চলেও যান।

ভারতের নদীয়া জেলার মুরুঠিয়া গ্রামের হামিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানালেন, ‘‘কাটাতারের বেড়া আমাদের স্বজনদের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। ’’ বাংলাদেশে বসবাসরত ছোট ভাই আসলামকে কাছে পেয়ে আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছি। এবারের ঈদের সব চেয়ে বড় আনন্দ নিকটজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারা। ’’

ভারতের ধাড়া গ্রামের মালতি রানী দাস এসেছিলেন ছোট মেয়ে সমাপ্তি রানী দাসকে দেখতে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে বাংলাদেশের কোদাইলকাটি গ্রামে প্রায় ৮ বছর আগে। বিয়ের পর একবার নিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। এরপর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৬ মাস বয়সী নাতনীকে কাছে পেয়ে ভালোলাগার অনুভূতিটুকু প্রকাশ করলেন চোখের জল ফেলে।
 
সকাল থেকে ভারতের নদীয়া জেলার করিমপুর থানার ধাড়া গ্রাম থেকে এসে অপেক্ষায় ছিলেন মা রহিমা খাতুন। দীর্ঘদিন পর একমাত্র সন্তান রাকিবুল ইসলামকে দেখে যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন তিনিও। ভুলে গেলেন পৃথিবীর সমস্ত দু:খ-বেদনাও।

রহিমা খতুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘তারকাটা আমার কলিজার টুকরাকে আলাদা করে রেখেছে। পাখি হলে প্রতিদিন আবার ব্যাটাকে (ছেলে) দেখতে যেতাম। ’’

‘‘সব সময় যদি এভাবেই আমার ছেলেকে দেখতে পারি তাহলে অনেক ভালো হয়। ’’

আবার অনেকে সীমান্তে এসেও স্বজনদের না দেখে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। সকাল থেকে অপেক্ষা করেও তাদের পক্ষে স্বজনদের দেখা পাওয়া সম্ভব হয়নি।

মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কোদালকাটি গ্রাম থেকে  ছুটে ছহিরুদ্দি এসেছিলেন ভারতে থাকা তার ছোট ভাই জহিরুদ্দিকে দেখতে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আজ ২৫ বছর ধরে আমার ছোট ভাই নদীয়া জেলার মুরুটিয়া থানায় থাকে। অনেক আশা নিয়ে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু দেখা করতে পেলাম না। জানি না, আর কখনও দেখা হবে কিনা?’’

তবে সবাই জানান, দুই দেশের দেখা করতে আসা স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে দিতে বিএসএফ সদস্যরা ভালো সাহায্য করেছেন। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে সীমান্তে ত্রিপল দিয়ে সাহায্য করেছেন তারা।

বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স অব ইন্ডিয়ার(বিএসএফ) সদস্য সমীর বমর্ণ বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘দুই দেশের মানুষকে আমরা দেখা করতে দিয়ে আমাদের ভেতরের সম্পর্ক আরো ভালো হচ্ছে। ’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা সাধারণত দুই ঈদের মধ্যে যে কোনো একটি ঈদে দেখা করতে দিয়ে থাকি। ঈদের দিন এবং ঈদের পরের দিন। এতে আমাদেরও অনেক ভালো লাগে। ’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত একে অপরকে দেখা করতে দিয়েছি উপরের নিদের্শে। ’’

বাংলাদেশ সময়: ২০২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১২   
এমআইএস/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।