ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

একি! বুড়াগুলোর এক পা কব্বরে চইলা গেছে, আর এরা করে কি!

হাবিবুর রহমান, হারবিন, চীন থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:১৫, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১২
একি! বুড়াগুলোর এক পা কব্বরে চইলা গেছে, আর এরা করে কি!

চীনে বৃদ্ধ লোকদের বয়স শোনার পর যখন তাদের কর্মযজ্ঞের সাথে মেলাতে পারি না তখন রীতিমত থতমত খেয়ে যাই। সত্তরোর্ধ বয়স্ক লোকজন দিব্যি একা একা রাস্তাঘাটে মাঠে-ময়দানে, বাজারে, বাসে-ট্রেনে চলাফেরা করছে।

তারা এই বয়সেও কীভাবে শরীরটাকে এত ফিট রেখেছে আর এত শক্তিই বা পায় কোথায় এর রহস্য যখন জানতে পাই তখন আফসোস হয়-- ইস্ আমার দাদা-নানা যদি এরকম পারত! আর ৬০ বছর বয়স্ক লোকরা তো রীতিমত জোয়ান ছাওয়ালের মত চলাফেরা করে!

আমার ল্যাবের শিক্ষকের বয়স ৬০ বছর। তিনি সিঁড়ি বেয়ে ৪তলায় অফিসে আসেন। সম্প্রতি নিজের গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। প্রতিদিন বাসা থেকে হেঁটে ক্যাম্পাসে আসেন।

বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুই বেলা থিয়াও-য়ু করে। থিয়াও-য়ু  হচ্ছে এক ধরনের নাচ। তবে নরমাল নাচের মত না যে প্রত্যেকটি মুদ্রা ধরে ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করতে হবে। মিউজিকের তালে তালে হাত-পা-কোমড় আস্তে আস্তে নাড়াচাড়া করতে হয়। তবে ভঙ্গিমা দেখতে বেশ লাগে। প্রথম প্রথম যখন দেখতাম চেষ্টা করতাম হাসি চেপে রাখতে কিন্তু পারতাম না, ফক করে দাঁতগুলো বের হয়ে যেত। এখনও দেখলে মুচকি মুচকি হাসি।

মাঝেমধ্যে দুই একজন মধ্যবয়সী মহিলারাও এতে যোগ দেন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হালকা কিছু খেয়ে ১ ঘণ্টার মত থিয়াও-য়ু করে আর সন্ধ্যার সময় দেড় ঘণ্টার মত। অবশ্যই এটা রাতের খাওয়ার পর করে। এখানে উল্লেখ্য, চাইনিজরা রাতের খাবার বিকেল ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে খায়। রাতের খাবারের ব্যাপারে মনে করে তাড়াতাড়ি খাওয়া উচিত যাতে ঘুমানোর আগেই খাবার হজম হয়ে যায়।

শরীরকে ফিট রাখার জন্য আর একটা বিশেষ ধরনের নাচ আছে যার নাম থাইচি-ছিউয়ান, এটা অনেকটা কুংফুর মত তবে খুবই ধীর গতির এবং কায়দা-কানুন সহজ। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে থাইচি-ছিউয়ান খুবই জনপ্রিয়।

শহরাঞ্চলে রাস্তার পাশে যেখানে একটু ফাঁকা জায়গা আছে সেখানে ব্যায়াম করার কিছু উপকরণ থাকে, এগুলো স্টিলের তৈরি। আমাদের দেশে শিশুদের খেলাধুলার জন্য পার্কে স্টিলের তৈরি যেসব উপকরণ থাকে, এগুলো দেখতে অনেকটা সেরকম। পাড়া-মহল্লার ভেতরে বাসভবনের সামনেও এগুলো দেখা যায়।

চৈনিক বৃদ্ধরা শারীরিক ব্যায়ামের ক্ষেত্রে আমাদের যুবকদের তুলনায় কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। এই বয়সেও এক পা উঁচু করে ৯০ডিগ্রি উৎপন্ন করে দুই পায়ের মাঝখানে। আমি নিশ্চিত, এদেরকে আমাদের দেশের স্টেজ শো গুলোতে অ্যাক্রোবেটিক ট্রুপের সদস্য হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিলে পাবলিকের হাততালি পাবেই পাবে।

আর শহরাঞ্চলের আনাচে-কানাচে ছোট ছোট পার্ক থাকায় বৃদ্ধদের সময় কাটানোর জায়গার অভাব নেই। এগুলোতে ঢুকতে কোনো পয়সা দিতে হয় না, সবই সরকারিভাবে করা। নানা ধরনের আয়োজন, এক এলাহি কাণ্ড। দেখে বিস্মিত হই। প্রথম দেখাতে মনে হয় একি! বুড়াগুলোর এক পা কব্বরে চইলা গেছে, আর এরা করে কি! বুড়া বয়সে ভিমরতি! ছোট বড় গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কিংবা এককভাবে নানা কিসিমের কাণ্ড করতেছে বুড্ডা মিয়ারা, তাদের মুখে আনন্দের আলোকছটা।

বুড়ো মহিলারা সিনজিয়াং এর ঐতিহ্যবাহী কাপড় পড়ে থিয়াও-য়ু, থাইচি-ছিউয়ান ড্যান্স করে, এসময় কয়েকজন মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজায় যেমন-- রান, এটা দেখতে অনেকটা বেহালার মত। এছাড়াও আছে কুজন। বুড়ো বয়সে একাকীত্বের যন্ত্রণা, মনমরা ভাব এগুলো নেই। আমাদের দেশে বয়স্কদের সাথে তো কেউ কথাই বলতে চায় না, সারাদিন একা একা থাকে। ‍

চাইনিজরা যে শুধু ওদের ঐতিহ্যগত জিনিসগুলোই করে তা না, পাশ্চাত্যের অনেক কিছুই অবসর যাপনের সঙ্গী হিসেবে নিয়েছে। যেমন-- বিউগল বাজানো, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস খেলা সামান্য একটু জায়গার মধ্যেই সম্ভব এবং বেশ মজার।
বলরুম ড্যান্সের মত কখনও একজন পুরুষ-একজন মহিলা কিংবা দুইজন মহিলা মিলে একজন আর একজনের হাত ধরে ড্যান্স করে। অবশ্য কখনও দুইজন পুরুষকে এটা করতে দেখিনি।

একদিন এক পার্কে ৬জন বৃদ্ধকে দেখেছি পুরো ইন্ডিয়ান সাজে ঢোল, মাদুলি নিয়ে নেচে নেচে গাইতে “হরে কৃষ্ণ, হরে রাম, হরে রাম” করছেন। ধর্মীয় কারণে ভজন সঙ্গীত গাইছেন কিনা জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, না, শ্রেফ বিনোদনের জন্য গানের তালে তালে শরীর দোলাতে হয়, মাথা ঝোকাতে হয় তাই এরকম করছেন। যা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল।

পার্কে কপোত-কপোতীদের তুলনায় বৃদ্ধদের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। অধিকন্তু শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধদের তুলনায় কম, আমাদের দেশের ঠিক উল্টো।

এটা একটা খেলা খেলে যার নাম মা-চিয়া। আরও খেলে চাইনিজ দাবা। এটা খুবই মজার। প্রত্যেকটা গুটি যে কোনো দিকে যেতে পারে।

আর আছে পাখি পোষা। প্রত্যেকদিন সকালবেলা বুড়োরা যার যার পোষা পাখি নিয়ে মহল্লার এক জায়গায় মিলিত হয়, যেন পাখির মিলনমেলা। এছাড়াও পোষা কুকুর কিংবা বিড়াল তো আছেই। অধিকাংশ বৃদ্ধাকে দেখা যায় পোষা কুকুর নিয়ে চলতে আর বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে পাখি।

একদিন সকালবেলা দেখলাম একটা মজার ঘটনা- এটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। এক বৃদ্ধ তার পোষা কুকুর নিয়ে জগিং করতেছে। কুকুরটা দেখতে হুবুহু একটা পুতুলের মত, প্রথম দেখাতে বোঝার উপায়ই নেই যে এটা একটা সত্যিকার কুকুর। একদম ছোট্ট পুতুলের সাইজের। শরীরের লম্বা লম্বা লোমগুলো পাট দিয়ে তৈরি পুতুলের মাথার চুলের মত, কান দুটো বেশ বড়। কুকুরটা দৌড়ে বৃদ্ধকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে এরপর থেমে পেছন দিকে তাকিয়ে মনিবের দিকে টিপ্পনি কাটছে। বৃদ্ধও থেমে যাওয়ার পাত্র নয়, সেও যথাসাধ্য চেষ্টা করে দৌড়াচ্ছে কিন্তু কিছুতেই পুতুল সদৃশ কুকুরকে ধরতে পারছে না।

চাইনিজ বৃদ্ধদের অবসর সময়ের বেশিরভাগ অংশ কাটে নাতি কিংবা নাতনীকে সঙ্গ দিয়ে। কারণ, অধিকাংশ পরিবারে ১ সন্তান। তাই একটা চাইনিজ বাচ্চাকে দেখাশোনা করে ৬জন মিলে, তার বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী।

এরা (শহুরে চাইনিজ শিশুরা) খুব আদর যত্নের মধ্যে বড় হয়। বাবা-মা সারাদিন অফিস আর অন্যান্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই বাচ্চা বড় হয় দাদা-দাদী, নানা-নানীর কোলে। থাকে বেশ যত্নেই।
habibur042002@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্‌সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।