মেহেরপুর: শুধুমাত্র দুইটা ঈদ আর দুর্গা পুজা এলেই চালু করা হয় মেহেরপুরের একমাত্র সিনেমা হল “মেহেরপুর হল”। এছাড়া বছরের বেশির ভাগ সময় হলটি বন্ধ থাকে।
মেহেরপুর জেলায় মোট ৭টি সিনেমা রয়েছে এগুলো হলো-মেহেরপুর শহরের মেহেরপুর, প্রান্তিক, প্রতিভা, নীলমনি, মুজিবনগরের সোনালিকা, গাংনীর ডাইমন্ড ও বামুন্দী রানা সিনেমা হল।
এরমধ্যে বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেছে ৬টি সিনেমা হল। এগুলো হলো- মেহেরপুর শহরের নীলমনি, প্রতিভা, প্রান্তিক, মুজিবনগরের সোনালীকা, ও গাংনীর ডাইমন্ড ও বামুন্দী রানা সিনেমা হল। বন্ধ হওয়া এ হলগুলোর মধ্যে ৫টির কোনো চিহ্নই নেই। হলগুলো ভেঙে সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেছেন হল মলিক।
তবে, গাংনী উপজেলার একমাত্র বামুন্দী রানা সিনেমা হলটি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ছাগলের খোয়াড় ও মাঝে মধ্যে তামাকের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন হল মালিক দবিরউদ্দীন।
মেহেরপুরে সবচেয়ে বেশি সিনেমা হল পরিচালনাকারী বশির উদ্দীন (হলবশির) বাংলানিউজকে জানান, স্বাধীনতার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের আক্তার ইমাম বিহারী নামে এক সিনেমা হল মালিক মেহেরপুর জেলার মূখার্জী পাড়ায় প্রথমে শ্যামলী পরে সেটি নীলমনি সিনেমা হল নামে প্রতিষ্ঠা করেন।
এরপর চলচ্চিত্র প্রযোজক ফারুক ঠাকুর মেহেরপুর শহরে প্রতিষ্ঠা করেন প্রতিভা সিনেমা হল। অবশ্য ফারুক ঠাকুর আক্তার ইমামের কাছ থেকে নীলমনি সিনেমা হলটি কিনে নিয়ে ছিলেন।
১৯৭৮ সালের দিকে শহরের কোর্টপাড়ার মুক্তার মহুরী মেহেরপুর শহরে (বর্তমানে ফুড গোডাউন পাড়া) তৈরি করেন প্রান্তিক সিনেমা হল। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা খোন্দকার আমিরুল ইসলাম পালু ৮২ সালের দিকে গাংনী উপজেলা শহরে তৈরি করেন ডাইমন্ড সিনেমা হল। অনেক আগেই নীলমনি সিনেমা হলটি ধ্বংস করে দেওয়া হলেও বাকিগুলো ২০০০ সালের পরে বন্ধ হয়ে গেছে।
মুজিবনগরের সোনালীকা সিনেমা হলের মালিক আলী হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, “১৯৮০ সালের দিকে বাংলা সিনেমা একটি অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল। ওই সময় সব শ্রেণী পেশার মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতো। এ সময় আমরাও মেহেরপুর, নীলমনি, প্রতিভা ও প্রান্তিক সিনেমা হলে সিনেমা দেখতাম। ”
তিনি আরও বলেন, “তখন সিনেমা হলগুলোতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো দর্শক। সিনেমা হলগুলোতে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ করা যেত। সে কারণে ৯০ দশকের দিকে বল্লভপুর মোড়ে সোনালীকা সিনেমা হল তৈরি করি। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশি সিনেমাগুলোর নায়ক নায়িকাদের নগ্ন পোশাক ও সিনেমার মানসম্মত কাহিনীর অভাবে দর্শক কমতে থাকে। সেই যে দর্শক কমতে লাগলো আর মানুষকে হলমুখি করা যায়নি। এক পর্যায়ে হলটি ভেঙে ফেলতে বাধ্য হই। ”
বামুন্দী রানা সিনেমা হলের মালিক দবিরউদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, “আমার বিশ্বাস বাংলা সিনেমার অতীত গৌরব আবারও ফিরে আসবে। আগেকার দিনের সেই সিনেমা পরিচালক, প্রজোযক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রয়েছেন। তারা ভূমিকা নিয়ে রুপালী পর্দার সেই সোনালী দিনগুলো ফিরিয়ে আনবেন। আর এ কারণে আমার রানা সিনেমা হলটি বন্ধ রাখলেও আজও ভেঙে ফেলিনি। ”
মেহেরপুর শহরের হালদারপাড়ার আব্দুর রহিম (৫৬) বাংলানিউজকে বলেন, “একটা সময় ছিল যখন বাংলা সিনেমার একটি সোনালী দিন ছিল,ছিল ঐতিহ্য। তাই বাবা মায়ের বকুনি, আর চাচা ও বড় ভাইয়ের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। শুধু সিনেমাই দেখতাম না সিনেমার সেই ডায়ালগ মুখস্ত করে নিয়ে এসে বন্ধুদের সামনে হুবহু বলতে পারতাম। ”
তিনি আরও বলেন, “সিনেমার কাহিনী,গানসহ আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলোতে যেন আলাদা মাধূর্য থাকতো। তাই আপন জনদের শাসন,বাধা উপেক্ষা করেই হলগুলোতে সিনেমা দেখতে যেতাম। এখন আর সিনেমা দেখি না। কতদিন যে সিনেমা দেখিনী এটা হিসাব করে বলতে পারব না। ”
এদিকে, গাংনী পৌর শহরের সিনেমা রফিক নামে পরিচিত রফিকুল ইসলাম (৬০) বাংলানিউজকে বলেন, “জীবনে এত পরিমাণ সিনেমা দেখেছি যা হিসাব করে বলতে পারবো না। একটা সময় ছিল যখন শুধুই সিনেমা দেখতাম। যার কারণে পাড়ার সবাই আমাকে সিনেমা রফিক বলে ডাকত। ”
গাংনী শহরের কাথুলি মোড়ের পান দোকানী শফিউল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, “ঘরে ঘরে ডিশ চ্যানেল ছাড়াও দোকানগুলো এখন পরিণত হয়েছে মিনি সিনেমা হলে। এছাড়া বাংলাদেশি সিনেমাতে অশ্লীলতার ছড়াছড়িসহ ভালো মানের কাহিনী না থাকার কারণেই মানুষ সিনেমা হলমুখি হন না। ”
পাঠক আগামীকাল বৃহস্পতিবার থাকছে নড়াইলের সিনেমা হলগুলোর প্রতিবেদন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: প্রভাষ চৌধুরী ও মাহাবুর আলম সোহাগ নিউজরুম এডিটর