ঢাকা: বিষয়টা বলা যায় একেবারেই সম্ভব ছিল না। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অসাধারণ ও মানবিক কর্তব্যবোধ আর একটি এনজিও’র উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়।
চতুর্থ মাত্রার ক্যান্সারে আক্রান্ত সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিক রুহুল আমীনের জীবন প্রদীপ নিভু নিভু বিষয়টি সবাই জানতেন। জেনে গিযেছিলেন তিনি নিজেও। দেশে স্বজনরাও জানতেন। এসময় তিনি তার অন্তিম ইচ্ছার কথা জানালেন, আমি দেশে ফিরতে চাই। পরিবারের সবাইকে দেখতে চাই!
মাস কয়েক আগে শরীর দুর্বল এবং কাশির প্রচণ্ডতায় ক্লিনিকে গেলে সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে রেফার করা হয়। ডাক্তার তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র এবং ঔষধ দিয়ে বিদায় করেন।
কিন্তু ঔষধ সেবনের পরও আরোগ্য লাভ না করায় ফের ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তাকে দ্রুত স্থানীয় তান তক সেন হাসপাতোলে পাঠানো হয়। সেখানে ডাক্তাররা রুহুল আমীনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হন তার ফুসফুস, হৃদপিণ্ড এবং যকৃতে পানি জমেছে এবং মরণব্যাধি ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে ৩টি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গেই। এছাড়া তার পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে আগামী সাতদিনও আয়ু পাবে কিনা সন্দেহ। তাকে সিঙ্গাপুরের সর্বোন্নত জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থার আওতায় রাখা হয় গত ১৩ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকেই।
এদিকে, রুহুল আমীনের শেষবারের মত পরিবারের সবাইকে দেখতে চাওয়ার আকুতিতে প্রবাসের সহকর্মী আর হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স সবাই আবেগাপ্লুত হলেন। কিন্তু উপায় কী! তাকে রোগী হিসেবে দেশে পাঠাতে হলেও যে একাধিক টিকিট দরকার। সে অনেক খরচা।
এমতাবস্থায় স্থানীয় ডাক্তারদের পরামর্শক্রমে তাকে দেশে ফেরত পাঠাতে বাংলা পত্রিকা ‘বাংলার কন্ঠ’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বিমানের কান্ট্রি ম্যানেজার আরিফ উল্লাহ’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মানবিক সহায়তার আশ্বাস প্রদান করে বলেন, হাসপাতাল থেকে যদি ডাক্তাররা ‘ফিট ফর ফ্লাই’ সার্টিফিকেট প্রদান করেন তবে রুহুল আমীনকে বহন করার জন্য প্রথম শ্রেণির তিন/চারটি সিটের ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। কিন্তু ডাক্তাররা তাকে সে ধরণের কোনো সার্টিফিকেট প্রদান করতে নারাজ। শুধুমাত্র এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করেই তাকে দেশে পাঠানো যেতে পারে- সাফ জানিয়ে দিলেন ডাক্তাররা।
রুহুল আমীনের পরিবার এয়ার অ্যাম্বুরেন্সের এতো বিপুল ব্যয়ভার বহন করতে অক্ষম। এসময় ঘটনাচক্রে একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স বাংলাদেশ থেকে ভিআইপি যাত্রী নিয়ে সিঙ্গাপুর আসলে ফেরার পথে শুধুমাত্র ওয়ান ওয়ে’র খরচে তাকে ২৭-০৯-১২ রাত সাড়ে ৮টায় সম্পূর্ণ জীবন রক্ষাকারী সাপোর্ট এবং একটি ছোট মেডিকেল টিমসহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
পরদিন শুক্রবার বাংলাদেশে স্বজনদের মাঝে উপস্থিত হন রুহুল আমিন। এরপর স্বজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় শেষনিঃস্বাস ত্যাগ করেন। অন্তিম আশা পূরণ হয় তার।
প্রসঙ্গত, রুহুল আমীনের চিকিৎসা সেবার সহযোগিতায় সিঙ্গাপুরে শ্রমজীবী অভিবাসীদের জন্য নিবেদিত সংগঠন ‘দিবাশ্রম’র চেয়ারম্যান দেবী ফরডাইস এবং বাংলার কণ্ঠ’র সম্পাদক এ কে এম মোহসীন এগিয়ে আসেন এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেন। ফলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যয়বহুল ১৫ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার খরচ বহন করেন শ্রমজীবী প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান টিডব্লিওসি টু’র একজন স্বেচ্ছাসেবী মিস মু অং।
এছাড়া রুহুল আমীনের পরিবারের জন্য আরোও ১০০০ সিঙ্গাপুর ডলার সহায়তা প্রদান করেন তিনি।
অসুস্থকালীন রুহুল আমীনের করুণ অবস্থার কথা জানিয়ে বাংলার কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হাই কমিশনারের একান্ত সহকারীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
এছাড়াও রুহুল আমীনের নিকটাত্মীয় এবং স্থানীয় স্বেচ্ছা চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হেলথ সার্ভ’র পক্ষ থেকে হাই কমিশনের শ্রম কাউন্সিলরকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
বাংলাদেশে রুহুল আমীনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান মাইগ্রেন্ট স্যাঙ্কচুয়ারি ফাউন্ডেশন (মিসাফ) বাংলাদেশ জানায়, জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বাংলাদেশ’র সহকারী পরিচালক জাহেদ হোসেন বিমানবন্দর থেকে রুহুল আমীনের গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়ার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেন।
বিষয়টি সিঙ্গাপুরের পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার পায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর