চারশো বছর আগের কথা। গ্রীস তখন অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত।
আলেকজান্ডারের জন্ম ৩৫৬ সালে। মা ছিলেন অস্বাভাবিক মানুষ। সম্রাট ফিলিপকে কোনো দিনই প্রসন্নভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। ফিলিপ যুদ্ধে ব্যস্ত সময় কাটালেও ছেলের দিকে নজর রাখতেন। আলেকজান্ডারের প্রথম শিক্ষক ছিলেন লিওনিদোস নামে অলিম্পিয়াসের এক আত্মীয়। আলেকজান্ডার ছিলেন অশান্ত এবং একরোখা। শিশু আলেকজান্ডারকে পড়াশোনায় মনোযোগী করতে হিমশিম খেতে হয়েছে লিওনিদোসকে। তবে তার আন্তরিকতায় একসময় পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। অংক, ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি।
কিশোর বয়স থেকেই তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল বীরোচিত সাহস। এই সাহসের সাথে সংমিশ্রণ ঘটেছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধির। একদিন একজন ব্যবসায়ী একটি ঘোড়া বিক্রি করেছিল ফিলিপের কাছে। এমন সুন্দর ঘোড়া সচরাচর দেখা যায় না। ফিলিপের লোকজন ঘোড়াটিকে মাঠে নিয়ে যেতেই হিংস্র হয়ে উঠল। যতবারই লোকেরা তার পিঠের উপর চড়তে যায়, ততবারই সে লাফিয়ে সবাইকে দূরে পাঠিয়ে দেয়। এসময় পুরো ঘটনাটি দেখছিল ফিলিপ এবং আলেকজান্ডার।
আলেকজান্ডার খেয়াল করলো ঘোড়াটি তার ছায়া দেখে ভয় পাচ্ছে। তাই ঘোড়ার পাশে গিয়ে আস্তে আস্তে তার মুখটা সূর্যের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। তারপর ঘোড়াটিকে আদর করতে করতে একলাফে পিঠের উপর উঠে বসেন। এসময় ছেলের সাহস ও বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হন ফিলিপ। তিনি ছেলেকে জেড়িয়ে ধরে বললেন, তোমাকে এভাবেই নতুন রাজ্য জয় করতে হবে।
ফিলিপ অনুভব করলেন তার ছেলের আছে অসাধারণ প্রতিভা। এ প্রতিভা বিকশিত করার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষার। এ সময় ফিলিপের আমন্ত্রণে ম্যাসিডনে আসেন মহাজ্ঞানী অ্যারিস্টটল।
২.
দীর্ঘ তিন বছর ধরে অ্যারিস্টটলের কাছে শিক্ষালাভ করেন আলেকজান্ডার। পরবর্তীকালে অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত, নিজেকে বিশ্বজয়ী হিসেবে গড়ে তোলার শিক্ষা আলেকজান্ডার পেয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের কাছে।
আমৃত্য গুরুকে গভীর সম্মান করেছেন আলেকজান্ডার। তার গবেষণার সমস্ত দায়িত্বভার নিজেই গ্রহণ করেন। নিজের গুরুর প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে আলেকজান্ডার বললেন, এ জীবন পেয়েছি পিতার কাছে। কিন্তু সেই জীবনকে কি করে আরও সুন্দর করতে হয়, সে শিক্ষা পেয়েছি গুরুর কাছে।
আলেকজান্ডারের যখন ষোল বছর বয়স, ফিলিপ বাইজানটাইন অভিযানে বের হলেন। পুত্রের উপর রাজ্যের সমস্ত ভার অর্পণ করলেন। ফিলিপের অনুপস্থিতিতে কিছু অধিনন্থ অঞ্চলের নেতারা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। কিশোর আলেকজান্ডার চুপ করে বসে রইলেন না। বীরদর্পে সৈন্যবাহিনী নিয়ে হামলা করলেন শত্রুদের দূর্গে। পরাজিত করলেন বিদ্রোহীদের। এমনকি বন্দী করে ম্যাসিডনে নিয়ে আসলেন।
যুদ্ধে জয়ী হয়ে আলেকজান্ডার মাতাল হয়ে পড়লেন। তিনি বিজয়ের নেশায় মত্ত হয়ে একের পর এক রাজ্য দখলের খেলায় নামলেন। এ বিষয়টি পিতা ফিলিপের পছন্দ হয়নি। এ নিয়ে শুরু হয় পিতা-পুত্রের দ্বন্দ। আলেকজান্ডারের কুড়ি বছর বয়সে ফিলিপ আততায়ীদের হাতে নিহত হন। ইতিহাসবিদদের মতে অবশ্য, এ হত্যার পেছনে রাণী অলিম্পিয়াসের হাত আছে বলে বলা হয়।
ফিলিপের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে রাজমহলের অভ্যন্তরে শুরু হয় কোন্দল। নতুন রাণীর মেয়েকে হত্যা করা হয়। এমনকি নতুন রাণীও আত্মহত্যা করেন। রাষ্ট্রে দেখা যায় অরাজকতা। আশেপাশের রাষ্ট্রগুলো শত্রুতায় রুপান্তরিত হয়। এদিকে ম্যাসিডনের নেতৃস্থানীয় সকলেই আলেকজান্ডার পরামর্শ দিল প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্র সম্পর্ক স্থাপন করতে।
কিন্তু এই পরামর্শ প্রত্যাখান করলেন আলেকজান্ডার। সুসংহত সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুদের উপর। প্রথমে আক্রমণ করলেন থেবেস। তারপর গেলেন কর্নিথে।
৩.
খ্রীস্টপূর্ব ৩২৮ সালের মধ্যে সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্য আলেকজান্ডারের অধিকারে এল। তার আগের বছর অবশ্য তিনি তার বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন। সে সময় ভারতবর্ষে ছিল অসংখ্য ছোট বড় রাষ্ট্র।
প্রতিবেশি সমস্ত রাজাই আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। শুধুমাত্র বশ্যতা অস্বীকার করে তক্ষশীলার রাজা অম্ভি প্রতিবেশি রাজা পুরু।
আলেকজান্ডারের ইচ্ছা ছিল আরও পূর্বে মগধ আক্রমণ করবেন। কিন্তু তার সৈন্যবাহিনী আর অগ্রসর হতে চাইল না। দীর্ঘ কয়েক বছর তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করে এসেছিল। আত্মীয় পরিজনের বিরহ তার মনকে উদাসী করে তুলছিল। এছাড়া দীর্ঘ পথশ্রমে যুদ্ধের পর যুদ্ধে সবাই ক্লান্ত। অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বদেশের পথে প্রত্যাবর্তন করলেন আলেকজান্ডার। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আলেকজান্ডার এসে পৌঁছলেন ব্যাবিলনে।
ব্যাবিলনে এসে কয়েকমাস বিশ্রাম নিয়ে স্থির করলেন আরবের কিছু অঞ্চল জয় করে উত্তর আফ্রিকা জয় করবেন। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে ২ জুন তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এগারো দিন পর মারা গেলেন আলেকজান্ডার। তখন দিন শেষে সন্ধ্যা নেমে আসছিল।
আলেকজান্ডার বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৩ বছর। তিনি চেয়েছিলেন পৃথিবীরব্যাপী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। তার মনের অতিমানবীয় এই ইচ্ছাকে পূর্ণ করার জন্য স্বল্পকালীন জীবনের অর্ধেকেই প্রায় অতিবাহিত করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তার বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য ঐতিহাসিকরা তাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি আসনে বসিয়েছেন। তাকে ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ নামে অভিহিত করা হয়।
নিরপেক্ষ বিচারে কি আলেকজান্ডারকে শ্রেষ্ঠ নৃপতি হিসেবে অখ্যা দেওয়া যায়? এই প্রসঙ্গে একজন বিখ্যাত জীবনীকার লিখেছেন, অনেকে তাকে মানব জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ গুণ তার সব দিয়েছেন। তবে তার বিশেষ দিকটি হলো, তিনি নগর স্থাপন করেছেন, দেশে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছেন।
তবে প্রকৃতপক্ষে আলেকজান্ডার সভ্যতা সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন না। তার কাছে খ্যাত ও প্রভুত্ব অর্জনটাই বড় ছিল। তবুও তিনি সাহসী যোদ্ধা হিসেবেই ইতিহাসে রয়ে গেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১২
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক