পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ইরান ও সৌদি আরব দশকের পর দশক ধরে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে পরিচিত। তবে ২০২৩ সালের মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক চুক্তির পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এক নতুন মোড়ে পৌঁছেছে।
ইরান-সৌদি সম্পর্ক: রেজা শাহ’র যুগে সহযোগিতা
ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বের মূল শিকড় নিহিত রয়েছে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিযোগিতায়। ইরান একটি শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে সৌদি আরব একটি সুন্নি ওয়াহাবি রাজতন্ত্র। যদিও ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ছিল না বললেই চলে। মোহাম্মদ রেজা শাহের সময় ইরান-সৌদি সম্পর্ক ছিল সহযোগিতাপূর্ণ, কৌশলগত, কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক। তেল, নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিতে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে।
১৯৬৬ সালে ইরানের সম্রাট মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভী এক ঐতিহাসিক রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি আরব যান। সফরকালে তিনি তার স্ত্রী ফারাহ দিবার সঙ্গে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজের আমন্ত্রণে রিয়াদে পৌঁছালে রাজকীয় মর্যাদায় তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। বাদশাহ ফয়সাল স্বয়ং বিমানবন্দরে গিয়ে শাহকে স্বাগত জানান এবং তার সম্মানে রাষ্ট্রীয় ভোজ ও সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। রেজা শাহ পাহলভীর সফরের সময় তাঁকে সম্মান জানাতে ঐতিহ্যবাহী সৌদি ‘তরবারি নৃত্য’–এর আয়োজন করা হয়। এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন তৎকালীন যুবরাজ সালমান বিন আবদুল আজিজ, যিনি বর্তমানে সৌদি আরবের বাদশাহ। সৌদি আলেমরা রেজা শাহ পাহলভীর হাতে চুমু খান।
সফরের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ অংশ ছিল মক্কা ও মদিনা পরিদর্শন, যেখানে শাহ কাবা শরিফে প্রবেশাধিকার পান—যা খুব কম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এই সফরের মাধ্যমে ইরান-সৌদি কূটনৈতিক সম্পর্কের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাবিষয়ক সহযোগিতার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
ইসলামি বিপ্লবের পর দ্বন্দ্বের শুরু
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবকে ইরান-সৌদি সম্পর্কে এক টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শাহ’র পতনের পর ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে গঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোতে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করে। বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনি (রহ.) মুসলিম দেশগুলোর জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন, “উঠে দাঁড়াও, ঐক্যবদ্ধ হও, নিজেদের শাসন নিজেদের হাতে নাও, আমেরিকা ও ইসরায়েলি আধিপত্য থেকে মুক্ত হও। ” তিনি আরও বলেছিলেন, “আমাদের বিপ্লব কেবল ইরানের জন্য নয়—এটি সমস্ত মজলুমদের বিপ্লব। ”
সৌদি আরব এই বার্তাকে রাজতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে শঙ্কা ও বিরোধ ঘনীভূত হয়।
প্রক্সি যুদ্ধ ও টানাপোড়েনের তিন যুগ
১৯৮০ সালে আমেরিকার মদদে ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে রিয়াদ সরাসরি বাগদাদকে সমর্থন দেয়। এতে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা আরও প্রকট হয়।
১৯৮৭ সালে হজের সময় সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রায় পাঁচ শতাধিক ইরানি হাজি নিহত হলে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছে। ইরানে সৌদি দূতাবাসে বিক্ষোভ ঘটে এবং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়ে যায়।
তবে ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি উভয় দেশকে বাস্তববাদী অবস্থানে নিয়ে আসে। ইরানের প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমি রাফসানজানি ও মোহাম্মদ খাতামির আমলে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু মাহমুদ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা আবার বাড়তে থাকে।
২০১১ সালের আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে বড়সড় পরিবর্তনের সূচনা করে, যার সবচেয়ে সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় সিরিয়া ও ইয়েমেন সংকটে। এই দুই সংঘাতে ইরান ও সৌদি আরব কার্যত বিপরীত পক্ষ নিয়ে সরাসরি কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়ে। সিরিয়ায় ইরান ছিল বাশার আল-আসাদের শক্তিশালী সমর্থক, আর সৌদি আরব সমর্থন করেছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে।
অন্যদিকে ইয়েমেনে হুথি আন্দোলনের প্রতি ইরানের নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের বিপরীতে সৌদি আরব সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে। ফলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল কূটনৈতিক বা মতাদর্শিক ছিল না—তা রূপ নেয় প্রক্সি যুদ্ধ ও সরাসরি সংঘাতে। আঞ্চলিক আধিপত্য, মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং ভিন্ন নিরাপত্তা স্বার্থ এই বিরোধকে আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।
চীনের শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি কর্মকর্তা ওয়াং ই (মাঝে), ইরানের নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি (ডানে) এবং সৌদি আরবের প্রতিমন্ত্রী মুসাদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান (বামে)।
২০১৬ সালে সৌদি আরবের শিয়া আলেম শেখ নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর ইরানে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালানো হলে কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ছিন্ন হয়ে যায়।
চীনের মধ্যস্থতায় নতুন অধ্যায়
দীর্ঘ বৈরিতার পর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরব আবারও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে পৌঁছায়। এই চুক্তি শুধু দুই রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব কমায়নি, বরং পুরো অঞ্চলেই শান্তি ও স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেছে। দু’দেশের দূতাবাস পুনরায় চালু হয় এবং বাণিজ্য, হজ ব্যবস্থাপনা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে নতুন করে সংলাপ শুরু হয়।
এই সমঝোতার পর উভয় দেশ ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছে। কূটনৈতিক মিশন পুনরায় চালু হয়েছে, বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল সফর করেছে, এমনকি প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
খামেনির সঙ্গে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঐতিহাসিক বৈঠক
২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল তেহরানে এক ঐতিহাসিক বৈঠকে সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বিন সালমান ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সৌদি বাদশাহ সালমানের একটি বার্তা পৌঁছে দেন এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আয়াতুল্লাহ খামেনি এই সফরকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ইরান ও সৌদি আরব একে অপরের পরিপূরক এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, আঞ্চলিক ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহায়তা বাইরের শক্তির ওপর নির্ভরতা কমাবে।
বৈঠকে খালিদ বিন সালমান বলেন, সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী এবং অতীতের বিভেদ পেছনে ফেলে গঠনমূলক পথে এগোতে চায়।
সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে সৌদির স্পষ্ট বার্তা
সম্প্রতি ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলা এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক অংশগ্রহণ এই দুই মুসলিম দেশকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। ১৩ জুনের ইসরায়েলি আগ্রাসনে ইরানের বেসামরিক নাগরিক, সামরিক কমান্ডার ও বিজ্ঞানীরা নিহত হন। এর জবাবে ইরান সরাসরি তেলআবিব, হাইফা এবং কাতারের আল-উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে শক্তিশালী পাল্টা আঘাত হানে। ২৪ জুনের মধ্যে, ইরানের সমন্বিত সামরিক অভিযান ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন কার্যত থামিয়ে দেয়।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র শক্তির ব্যাপকতা ও নির্ভুলতা ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে বিস্মিত করে দেয়।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, “যদিও ইসরায়েলের কাছে অ্যারো, ডেভিড’স স্লিং ও আয়রন ডোমের মতো উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যুদ্ধের শেষ দিকে এসে তারা নিজেদের ইন্টারসেপ্টর সংকটে পড়ে এবং মজুত রক্ষা করতে বাধ্য হয়। যদি ইরান আরও কয়েকটি বড় আকারের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করত, তাহলে ইসরায়েলের অ্যারো-৩ মুনিশনের মজুত নিঃশেষ হয়ে যেত। ”
পত্রিকাটি আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো দুটি উন্নত ‘থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থাও ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পুরোপুরি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, “ইসরায়েলি ব্যবস্থার সঙ্গে একত্রে কাজ করেও থাড অপারেটররা দারুণ চাপের মুখে পড়ে, মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে। ”
এই তীব্র চাপ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে পেন্টাগন সৌদি আরবের জন্য কেনা থাড ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলকে পাঠানোর কথাও বিবেচনা করে।
দুই মার্কিন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে মিডল ইস্ট আই সম্প্রতি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবকে অনুরোধ করেছিল থাড আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইন্টারসেপ্টর ইসরায়েলকে দিতে, কিন্তু রিয়াদ তা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে। সৌদি আরবের এই অস্বীকৃতি ইরানের সঙ্গে তাদের গভীরতর সম্পর্ককেই তুলে ধরে।
৮ জুলাই, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান জেদ্দায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি ইরানের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধে যে কোনো সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা জানান এবং দুই ইসলামি শক্তির মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশকে স্বাগত জানান।
আরাগচি সৌদি আরবকে ইরানের ওপর ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করার জন্য ধন্যবাদ জানান।
তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব ও পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক জোরদারে ইরানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। আরাগচি সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহানের সঙ্গেও বৈঠক করেন, যেখানে তারা কৌশলগত সহযোগিতা জোরদারে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
ভবিষ্যতের আঞ্চলিক কৌশল: প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে সহযাত্রী
ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি এখন আর শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যের সীমায় আটকে নেই—বরং তা ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে একটি যৌথ আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোর দিকে।
দীর্ঘ বিভাজনের অধ্যায় পেছনে ফেলে, যদি তেহরান ও রিয়াদ বন্ধুত্ব ও কৌশলগত মৈত্রীর ভিত্তি আরও দৃঢ় করতে পারে, তবে সেটি শুধু দুই দেশের জন্য নয়—বরং পুরো অঞ্চল এবং বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের জন্যও হতে পারে এক নতুন যুগের সূচনা।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধ নয়—সংলাপ; বিভাজন নয়—ঐক্য, এই উপলব্ধি থেকেই যদি উভয় পক্ষ ভবিষ্যতের নীতি নির্ধারণ করে, তাহলে পশ্চিম এশিয়ায় শুরু হতে পারে এক নতুন কৌশলগত বাস্তবতা, যেখানে নেতৃত্ব থাকবে আর কোনো বহিরাগত শক্তির হাতে নয়—নিজেদের হাতেই। সেই পরিস্থিতিতে ইহুদিবাদী ইসরায়েলও কোণঠাসা হয়ে পড়বে এবং ত্বরান্বিত হবে ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত মুক্তিসংগ্রাম।
এমজেএফ