ঢাকা, শনিবার, ২৫ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৪ সফর ১৪৪৭

ফিচার

শবনমের দেশে-১

ঐতিহ্যের শহর থোয়া: যেখানে কাঠের গায়ে লেগে আছে সময়ের ধুলো

মুমিন আনসারি, ফ্রান্স করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৮, আগস্ট ৯, ২০২৫
ঐতিহ্যের শহর থোয়া: যেখানে কাঠের গায়ে লেগে আছে সময়ের ধুলো

সময় ১৫২৪ সাল। গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরুর আগে শুকনো বাতাসের এক বিকেল।

প্রায় প্রতিটি গেরস্থ ব্যস্ত রান্নার কাজে। হঠাৎ একটি ঘরের রান্নাঘরে লেগে গেল আগুন। দাউদাউ করে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে সে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ল। ধোঁয়ায় ঢেকে গেল আকাশ। এই অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেল ১৫০০ বাড়িঘর। গৃহহীন হয়ে পড়ল সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ।

ঘটনাটা প্যারিসের খুব কাছের এক শহর থোয়ার। আজ থেকে ঠিক ৫০১ বছর আগের কথা। কে জানত এই ঘটনাটিই থোয়াকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করিয়ে দেবে সিতে দ্য পাত্রিমোয়ান বা ঐতিহ্যের শহর হিসেবে! যেন সময়কে আলতো করে ধরে রেখেছে শহরটি।

প্যারিস থেকে দেড়শ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে থোয়ায় পৌঁছানোর পরই টের পাওয়া যায়, ইতিহাস শুধুই পাঠ্যবইয়ের পাতায় আটকে নেই। এখানে ইতিহাস হাঁটে রাস্তায়, দাঁড়িয়ে থাকে জানালার গা ঘেঁষে। কাঁপাকাঁপা কাঠের বুকে গেঁথে রাখা প্রতিটি বাড়িই যেন অতীতের দিকে ফিরে তাকানো এক স্থির চাহনি।

১৬ শতকের গোড়ায় ফ্রান্সের শ্যাম্পেইন অঞ্চলের এই শহরটি ছিল বাণিজ্য ও তাঁতশিল্পের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু ১৫২৪ সালের সেই বিভীষিকাময় আগুন থোয়াকে ইতিহাসের খরস্রোতা নদীতে ছুড়ে ফেলে। তবু থোয়া আবার উঠে দাঁড়ায়— তবে এবার একটু ভিন্নভাবে।

অগ্নিকাণ্ডের পর, নতুন নিয়ম আসে সরকারের পক্ষ থেকে— নতুন বাড়িগুলোর নিচতলা হবে পাথরের, তার ওপরের তলা কাঠের। যেন আগুন আবার পুরো শহর গিলে খেতে না পারে। এই মিশ্র নির্মাণশৈলীকে বলা হয় কলমবাজ বা টিম্বার ফ্রেমিং। ১৪০০ থেকে ১৬০০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সজুড়েই এই নির্মাণশৈলী জনপ্রিয় ছিল। সব শহর আধুনিক স্থাপত্যশিল্পকে আলিঙ্গন করলেও থোয়া সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এক বিশ্ববিরল ‘স্থাপত্যঘন পাড়া’র রূপে।

পালিশ না করা কাষ্ঠখণ্ড— যেগুলো এখন রোদে পোড়া বাদামি, নীল-সবুজ, ফিকে হলুদ কিংবা কফিরঙা দেয়াল— সব মিলে এক কাব্যিক জ্যামিতি তৈরি করেছে। তাই শহরটির আরেক নাম ‘হাজার রঙের শহর’ (লা ভিল ও মিল কুলার)। কাঠ আর পোড়া মাটির এই বন্ধনে মিশে আছে তখনকার দিনমজুর, কাঠুরে, ইটকামারের শ্রম আর শৈল্পিকতা।

প্রতিটি কাঠের বাড়ি যেন একটি আলাদা চরিত্র ধারণ করে। কোনো কোনো বাড়ি খানিকটা ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। তার জানালাগুলো থেকে সূর্যের বিচ্ছুরিত আলো জানান দেয় সময়ের। আবার কোনোটা রাস্তার দিকে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে রেখে যেন দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায়।

২০১৩ সালে থোয়া শহরের কেন্দ্রস্থলকে ঘোষণা করা হয় সংরক্ষিত এলাকা (সেকতুর সোভগার্দে) হিসেবে। এর ফলে ভবনের মালিকদের বাড়িতে সংস্কার বা পরিবর্তন করতে হলে মানতে হয় কড়াকড়ি নিয়ম। শহরের ঐতিহ্য যেন নষ্ট না হয়, সেই দিকে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া হয়।

পরবর্তী শতকগুলোয় সেগুলোর সংস্কার হয়। কিছু নতুন করে তৈরি হয় পুরোনো ঢঙে। থোয়া শহরের যেসব কাঠের বাড়ি আজ দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে, তার কিছু ১৬-১৭ শতকের, আবার কিছু ১৯ শতকে পুরনো কাঠামোর আদলে তৈরি। যেমন— মেজঁ দ্যু বুলাঞ্জে, ওতেল দ্য মোয়্‌রোয়া, বা ওতেল দ্য ভোলুইজঁ।

থোয়ার শুধু বাড়িঘর নয়, তিন তারকা বা চার তারকা আবাসিক হোটেলগুলোও একই রকম— সেই ৫ শতাব্দি প্রাচীন শৈলীতে তৈরি। রাতে যেন পোড়ামাটি আর কাঠগুলো ফিসফিস করে, পর্যটকদের ইতিহাসের কথা শোনায়। আলো-ঝলমলে এই শহরগুলো থেকে মুহূর্তেই তারা চলে যায় ৫০০ বছর আগে। মনে করিয়ে দেয়— এখানেও একটা পরিবার ছিল, যারা কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে ঠিকই, তবে ঐতিহ্যের এই ছোঁয়া রেখে গেছে আমাদের জন্য।

আর এই রূপকথার ঘরবাড়িগুলোর নির্মাণশৈলীও ঠিক তেমনই বিশেষ। ‘কলমবাজ’ এক ধরনের মধ্যযুগীয় পদ্ধতি, যেখানে কাঠের ফ্রেম দিয়ে বাড়ির গঠন তৈরি হয়। ফাঁকা জায়গা ভরাট করা হয় ইট, পাথর বা মাটির মিশ্রণে। কাঠের সজ্জা থাকে বাইরে থেকেও দৃশ্যমান, অলঙ্করণে থাকে চিত্রকল্পের ছোঁয়া।

কাঠগুলো দেয়ালের মাঝখানে স্থাপন করা হয় বিভিন্ন ডিজাইনে— কখনো ত্রিভুজাকৃতির, কখনো রম্বসের মতো, কখনো সমান্তরাল রেললাইনের মতো, কখনো গাণিতিক গুণচিহ্নের মতো, আবার কখনো আনমনে অবহেলায় কোনো প্রতিকৃতি ছাড়াই কাঠগুলো বসানো হয়েছে। শহরের মাঝখানে কাঠের বাড়িগুলোর সামনেই রয়েছে কূপ, যেখান থেকে পানি তুলে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করা হতো। এখন ঢাকনা দিয়ে সিলগালা করে রাখা আছে।

আজকের থোয়ায় এসব শতাব্দীপ্রাচীন কাঠের ঘরের নিচতলায় আধুনিক জীবনের নীরব স্বাক্ষর হয়ে আছে একের পর এক ছোট ছোট দোকান। কোথাও পাথরের মেঝেতে পা রেখেই চোখে পড়ে কাঠের তাকজোড়া কফিশপ, যার কাঁচঘেরা জানালার ওপার থেকে ভেসে আসে অ্যারাবিক কফির গন্ধ আর নরম জ্যাজ সুর।

আবার কোনো কোনো দোকান পুরোনো কাঠামোর ভেতরেই জায়গা করে নিয়েছে হস্তনির্মিত চামড়ার ব্যাগ, জামা আর প্রাচীন শৈলীর অলংকারের জন্য। কিছু দোকানে বিক্রি হয় থোয়ায় তৈরি সুগন্ধি, হানিমোম, এমনকি স্থানীয় ভিনটেজ ওয়াইন— যেগুলো সাজানো থাকে কাঠের ফ্রেমঘেরা শেলফে, যেন দোকানটাই এক প্রদর্শনীঘর। কিছু নিচতলায় আবার ছোট বুকস্টোর, পুরোনো ছাপা বইয়ের গন্ধে সেঁচানো, দেয়ালে ঝোলানো মধ্যযুগীয় ছাপচিত্র। এভাবে পুরোনো কাঠের গায়ে ঝুলে থাকা আধুনিকতা যেন প্রমাণ করে— সময় কেবল চলে না, সে নিজেকে পুরোনো শরীরে নতুন করে ফুটিয়ে তোলে।

শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে সেন নদীর ছোট শাখা। কালো-লাল কাঠের ফ্রেমের বাড়িগুলো আর চার্চের ঘণ্টাধ্বনি— সব মিলে থোয়া যেন ‘স্থির সময়ে’ দাঁড়িয়ে থাকা এক শহর। প্রতিবছর লাখো পর্যটক আসে এখানে, হেঁটে বেড়ায় র্যু এমিল জোলা বা র্যু শঁপো ধরে, ছবি তোলে, এক কাপ কফিতে চুমুক দিয়ে অনুভব করে ইতিহাসের কাঠের গন্ধ। এই শহরের পথে হাঁটলে এখনও বাতাসে পাওয়া যায় সেই পুরোনো দগ্ধ গন্ধ। পুরোনো কাঠের দরজাগুলোর ফাঁকে লুকিয়ে আছে ইতিহাস, আর তার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন কিছু কাঠের ঘর।

এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।