১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস। যুদ্ধকালীন বিপজ্জনক সময়।
জবাবে বৈঠকে উপস্থিত পাকিস্তানি সামরিক জেনারেলগণ বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তারা গেরিলা অপারেশনে দুর্দান্ত সাহসী এবং সফল। তারা মৃত্যুকে ভয় করে না।
পাকিস্তানি সামরিক জেনারেলদের কথার ফাঁকে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টো ও উপস্থিত নেতৃবৃন্দ মন্তব্য করেন, বাঙালি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে না পারলে পূর্ব পাকিস্তান শাসন বা সংরক্ষণ-- কিছুই করা যাবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার ছেড়ে দিতে হবে। বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ করে ছাড়বে। তাতে কোনো রকম সন্দেহ নেই।
বৈঠকে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য দালাল দলগুলোর নেতারা বলেন যে, আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানে বেঁচে থাকতে কোনো অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না এবং বাঙালিদের কোনোরকম দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানপন্থী সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একযোগে শেখ মুজিবুর রহমানের ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল গোষ্ঠী এ কথা বলার পর সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানকে জোরালো কণ্ঠে নির্দেশ দিলেন, আপনি দ্রুত ব্যবস্থা নিন। আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাই না, চাই শুধু মাটি। বাঙালিদের দাবি-দাওয়া কিছুই মেনে নেওয়া যাবে না, মেনে নেব না।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কথার শেষে বৈঠক শেষ হয় এবং পরবর্তী সময়ে টিক্কা খানসহ জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ তথা কুখ্যাত রাজাকার আলবদর আল শাম্স পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে তারা সবাই ঢাকায় টিক্কা খানের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতা স্বাধীনতা বিরোধী ষড়যন্ত্রকারী ও বুদ্ধিজীবী গণমানুষ হত্যাকারী কুখ্যাত রাজাকার অধ্যাপক গোলাম আজম, মুসলিম লীগের নেতা খান এ সবুর, মশিউর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী (ফকা চৌধুরী), তার পুত্র সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অন্যান্য পাণ্ডারা। বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট পরিচালনাকারী পাকি হানাদার বাহিনী প্রধান জল্লাদ টিক্কা খান ঘোষণা করেন, যেভাবে হোক পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে শেষ করে দিতে হবে। বাঙালিদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে হবে এবং সমস্ত পূর্ব-পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দিতে হবে। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে এই পূর্ব পাকিস্তানকে আবার আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিরা নতুন করে গড়ে তুলবো। এই পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতির কোনো অস্তিত্ব চাই না। এই পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের অস্তিত্ব রাখবো না, চাই শুধু মাটি। প্রয়োজনে সমস্ত বাঙালি জাতিকে হত্যা করবো।
টিক্কা খানের এই ঘোষণার পর পাকিস্তানের কুখ্যাত দালাল ও রাজাকারেরা ঢাকা হতে চট্টগ্রামে এসে ২ দিন পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে এক সভায় মিলিত হন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন কুখ্যাত রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাশিম আলী ও আবু তাহের এবং মুসলিম লীগ নেতা আবদুন নবী চৌধুরীসহ আরও অনেক স্বাধীনতা বিরোধী জল্লাদ। তারা উপস্থিত বৈঠকে জেলা প্রশাসককে ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনার সমস্ত বিষয় জানান। তাদের সমস্ত কথাবার্তা শুনে জেলা প্রশাসক তাদেরকে বলেন যে, ঠিক আছে। আপনারা বেশ কিছু পাকিস্তানি সমর্থক রাজনৈতিক নেতা এখানে আছেন। কোন কৌশলে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ও শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত কর্মকাণ্ড ধ্বংস করা যাবে তা ঠিক করেন। জেলা প্রশাসক এই কথা বলার পর পাকিস্তানি রাজাকার গোষ্ঠী জেলা প্রশাসককে বলেন, ঠিক আছে আমরা আগামী পরশু সকাল ১০টার সময় পাকিস্তানপন্থি নেতারা এ বিষয়ে সামরিক অফিসারদেরকে নিয়ে পুনরায় এখানে মিটিংয়ে বসবো। ওই মিটিংয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, কোন কোন কৌশলে শেখ মুজিবুর রহমানের সমস্ত কর্মকাণ্ড নস্যাৎ করা যাবে এবং কোন কোন কৌশলে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম বন্ধ ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা তথা সমস্ত বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে।
এ সিদ্ধান্তের পর কুখ্যাত রাজাকারদের ওই মিটিং শেষ হয় এবং তারা তাদের নিজ নিজ অবস্থানে চলে যায়। তৎক্ষণাৎ জেলা প্রশাসক তার পিএ-কে ডেকে বলেন যে, এই মিটিংয়ে যে সমস্ত এজেন্ডার ওপর কথাবার্তা হয়েছে তার সমস্ত কিছু টাইপ করে কপি কর। জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে পিএ কপি টাইপ করে। টাইপকৃত ওই কপি থেকে জেলা প্রশাসকের পিয়ন মো. আলী একটি কপি তার কাছে গোপনে রেখে দেন। ৩০ মিনিট পরে মো. আলী গোপনে এসডিও’র পেশকার নুরুল ইসলামের কাছে গিয়ে রাজাকারদের মিটিং সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় জানান এবং তাদের কথাবার্তার রেকর্ড করা কপিটি তাকে দেন। এরপর ইতিকর্তব্য নির্ধারণে দু’জনই গভীর চিন্তায় পড়ে যান।
পরে মো. আলী পেশকারকে বলেন যে, আমার বাসার পাশে একজন দেশপ্রেমিক সংগ্রামী মানুষ আছেন। তিনি আগ্রাবাদে অসহযোগ আন্দোলনসহ বহু সংগ্রামী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তার নাম মো. গরীব উল্যাহ। মনে হয় তাকে এই সমস্ত বিষয়ে খুলে বললে একটা কিছু করতে পারে।
জবাবে পেশকার নুরুল ইসলাম বললেন যে, যদি লোকটা দেশপ্রেমিক বা শেখ মুজিবুর রহমানের খাঁটি সমর্থক হয় তাকে বলতে পার। কিন্তু খুবই সাবধান, খুবই সতর্ক থাকবে। কারণ, এই সমস্ত কথাবার্তা হিসাবের বাইরে একটুও বলা যাবে না। কারণ, সময় খুবই খারাপ। হিসাবের বাইরে বললে বিপদ হয়ে যাবে, যদি লোকটা সঠিক মনে কর তাহলে তাকে দ্রুত বল এবং জরুরি ভিত্তিতে একটা ব্যবস্থা করতে বল। যাও তুমি, এক্ষুণি এই অবস্থায় চলে যাও। তার সাথে দেখা কর।
সেদিন বিকাল ৫ ঘটিকার সময় তখন আমি মো. গরীব উল্লাহ চট্টগ্রাম শহর অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের বিএলএফ কেসি-৩ ট্রেনিং সেন্টার এবং যুদ্ধ পরিচালনার প্রধান কার্যালয় মোগলটুলী মাতব্বর বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। এসময় জানাতে পারলাম, মো. আলী নামে একজন আমাকে পাগলের মত খোঁজাখুঁজি করছে। এক পর্যায়ে মো. আলীর সাথে আমার দেখা হয়।
তিনি আমাকে দেখামাত্র বলেন, আচ্ছা ভাই, গরীব উল্লাহ ভাইকে আপনি চিনেন? তাকে এই মুহূর্তে আমার একান্ত দরকার।
আমি বলি, কি ব্যাপার? গরীব উল্লাহকে তোমার কী দরকার, তুমি কোথা হতে এসেছ? মো. আলী আমাকে বলেন, সে অনেক কথা শুধুমাত্র তাকেই বলা যাবে। আপনাকে বলা যাবে না। আমি এই বিপজ্জনক যুদ্ধের সময় অনেক কষ্ট করে এখানে এসেছি। আমাকে তার কাছে নিয়ে চলেন। আমি মো. আলীর কথা শুনে তখন তার নাম জিজ্ঞাসা করি। তিনি জানান, তার নাম মো. আলী। কোথায় থাকেন বা কোত্থেকে এসেছেন জিজ্ঞাসা করলে বলেন, আমাকে এত কথা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন নেই। তাকে আমার জরুরি দরকার, তাকেই সব বলা যাবে। গরীব উল্লাহ ভাইকে আপনি চিনেন কি না বলেন? চিনলে তার কাছে আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলেন। তার কথাবার্তায় সন্দেহ করলাম। মনে করলাম সে পাকি হানাদার বাহিনী তথা রাজাকারদের গুপ্তচর। সে আমাকে পাকিহানাদার বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এসেছে। তাকে কোনো অবস্থাতেই আমার পরিচয় দেওয়া যাবে না বরং তাকে এখানেই শেষ করে দিতে হবে। তখন আমি তাকে শক্ত অবস্থানে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি এবং তাকে বলি যে, তোমাকে কোন রাজাকারের বাচ্চা পাঠিয়েছে বল। তা না হলে আজকে তুমি এখান থেকে কোনো অবস্থাতেই জীবিত ফিরে যেতে পারবে না। এ কথা বলে সাথে সাথে আমি তার মাথায় রিভলবার তাক করি এবং সত্য কথা বলার জন্য চাপ সৃষ্টি করি।
এমতাবস্থায় মো. আলী আমার পা চেপে ধরে এবং কান্না জড়িত কণ্ঠে একে একে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন এবং টাইপ করা একটি কাগজ আমাকে দেন। এবং বলেন, এই টাইপ করা কপিতে তাদের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সবকিছু লেখা আছে। আপনি দেখেন এবং আমাকে গরীব উল্ল্যাহ ভাইয়ের নিকট নিয়ে যান। এতোসব কথা বলার পরেও তাকে আমি পরিস্থিতির কারণে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তখন আমি তাকে বলি যে, তুমি কি মুসলিম না হিন্দু? তোমাকে চেক করতে হবে। তখন আমি মো. আলীকে আমাদের মোগলটুলী জামে মসজিদে নিয়ে গেলাম এবং ধর্ম বিধিতে শক্ত অবস্থানে যাহা যাহা প্রয়োজন মনে করে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করলাম। যাচাইয়ে মো. আলীর প্রতি কিছুটা বিশ্বাস স্থাপন হল। যাচাই শেষে তার সাথে ভাল আচরণ করে আমার পরিচয় গোপন রেখে তাকে বিদায়ের সময় বলি, গরীব উল্ল্যাহ ভাইকে আমি বলবো এবং গরীব উল্লাহ ভাইকে কালকে যে কোনো সময় কোর্ট বিল্ডিংয়ে পাঠাবো। এই কথা বলে আমি তাকে বিদায় করে দিলাম এবং সাথে সাথে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরেরদিন সকালে ১০ঘটিকার সময় অপারেশনের কৌশল ঠিক করার জন্য কোর্ট বিল্ডিংয়ে যাই। যাওয়ামাত্র কোন কোন পয়েন্ট থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে আক্রমণ বা গ্রেনেড চার্জ করলে অপারেশন সফল করা যাবে প্রথম তা ঠিক করলাম এবং অপারেশন শেষ করে কোন পয়েন্টে নিরাপদে ফিরে আসতে পারবো তাও ঠিক করলাম।
অপারেশন পয়েন্টগুলো পর্যবেক্ষণ শেষ করে কোর্ট বিল্ডিংয়ে বটগাছের নিচে মো. আলীর সঙ্গে দেখা করি। দেখা হওয়া মাত্র আলী আমাকে প্রশ্ন করেন, গরীব উল্ল্যাহ ভাই কোথায়? তিনি আসেননি, আপনি একা কেন এসেছেন? তার কথার জবাবে আমি তাকে বলি যে উনি অর্থাৎ গরীব উল্ল্যাহ ভাই সময়মতো আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তুমি কোনো চিন্তা করো না।
এ কথা বলার পর মো. আলী একেবারে মনটাকে ছোট করে খুবই দুর্বল কণ্ঠে আমাকে বলেন যে, আসলে আমি যেভাবে আশা করে গরীব উল্যাহ ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম মনে হয় তা পূরণ হবে না। মনে হয় পাকিস্তানি ও রাজাকার আলবদরদের কার্যকারিতা সফল হয়ে যাবে। যদি তাদের কার্যক্রম সফল হয়ে যায় তাহলে তো এই দেশে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে না। বাঙালিদের অধিকার থাকবে না এবং সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন কোনোদিন বাস্তবায়ন হবে না। এই দেশটা যে কী হবে তাও জানি না।
মো. আলীর কণ্ঠে এমন অসহায়ত্বের প্রকাশ দেখে তখনি মনে হয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানি তথা রাজাকারদেরকে চিরতরে শেষ করে ফেলি কিন্তু কৌশল ছাড়া কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। তখন আমিও মো. আলীর মতো অসহায়ত্বের ভান করে ধৈর্যধারণ করলাম এবং তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আলী তুমি কোনোরকম চিন্তা করো না। আল্লাহ্ তা’য়ালার ওপর বিশ্বাস রাখ। নিশ্চয় মহান রাব্বুল আলামীন তোমার আশা পূরণ করে দিতে পারে।
তার মনের অবস্থা দেখে আমার মনে হয়েছিল যে, এই একজন মো. আলী কত বড় দেশপ্রেমিক মানুষ! তাকে মূল্যায়ন করার মতো যোগ্যতা আমার এবং গোটা জাতির আছে কি-না সন্দেহ পোষণ করি।
এরপর মো. আলী আমাকে বলেন যে, গরীব উল্ল্যাহ ভাই যখন আসেননি, আপনি একটু তার মানুষ হিসাবে পেশকার সাহেবের সাথে দেখা করে গেলে ভালো হয়। কারণ এই পেশকার সাহেব গরীব উল্ল্যাহ ভাইয়ের নিকট জোরপূর্বক আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের মানুষ, পাকিস্তানিদেরকে একেবারে দেখতে পারেন না। এ কথা বলে মো. আলী আমাকে পেশকার নুরুল ইসলামের কাছে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাকে বলেন, এই লোকটা হচ্ছে গরীব উল্ল্যাহ ভাইয়ের একান্ত আপন মানুষ। তাকে সবকিছু বলা যাবে। কোনো রকম অসুবিধা হবে না।
পেশকার সাহেব আমাকে বলেন, যদি সম্ভব হয় একটু গরীব উল্লাহ ভাইকে নিয়ে আসেন। তার সাথে জরুরি কথা বলতে হবে। আগামীকাল সকাল ১০টার সময় নরপশু পশ্চিম পাকিস্তানিদের মিটিং কোর্ট বিল্ডিং জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। এই মিটিংয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতি তথা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব বিনাশের সিদ্ধান্ত নেবে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তথা রাজাকার আলবদর আল শামস এরা বাঙালি জাতিকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য এতোবড় একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অথচ মুক্তিযোদ্ধারা কোথায়? তারা কী করতেছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তাই গরীব উল্ল্যাহ ভাইকে এই মুহূর্তে একান্ত প্রয়োজন। তার সাথে কথা বলা খুবই জরুরি। তার কথার শেষে তাকে আমি বলি যে, আপনি কোনো রকম চিন্তা করবেন না। দেখা যাক গরীব উল্লাহ্ ভাইকে বলে কিছু করা যায় কি-না। একটু ধৈর্য্য ধরেন। মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার ওপর বিশ্বাস রাখেন।
এরপর তার সাথে আরও কিছু কথাবার্তা বলে মোগলটুলীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয়ে চলে আসি। আসা মাত্র ডা. মাহফুজুর রহমানকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু শত খোঁজাখুঁজির পরও মাহফু ভাইকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম এবং নিজকে নিজ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বাঙালি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও এই অপারেশন আমাকে অবশ্যই করতে হবে।
অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র আমার ঘরেই আছে। অস্ত্র ও মালামাল ব্যবহার করতে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। অপারেশনের ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছিলাম। এসময় মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান ফকির এসে হাজির। তাকে দেখামাত্র ডা. মাহফুজুর রহমানের কথা জিজ্ঞাসা করি। তিনি বলেন, আমি তাকে দু’দিন যাবত দেখছি না, জানি না কোথায় আছেন।
ফকিরকে বলি, আগে ভাত খেয়ে নাও পরে কথা হবে। আমার মা হাজেরা খাতুনকে বললাম, দু’জনকে ভাত দিতে। দেয় ভাত খাওয়ার পর পনের বিশ মিনিটের মতো বিশ্রাম করি। বিশ্রামের ফাঁকে ফয়জুর রহমানকে কোর্ট বিল্ডিং অপারেশন পরিকল্পনার সমস্ত কথা বলি এবং জানাই আগামীকাল সকাল ৭ ঘটিকার সময় অপারেশন স্থানে উপস্থিত হবো। দেরি করে গেলেই আমরা কোর্ট বিল্ডিংয়ে ঢুকতে পারবো না। আমাদের অপারেশনও সফল হবে না। সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাবে। ফকিরকে এই কথা বলার পর মাকে বললাম, মা, আমাকে দুইটা পাঞ্জাবি, দুইটা পায়জামা, দুইটা টুপি, দুইটা তসবির ছড়া, দুইটা গায়ের চাদর দেন। এগুলো লাগবে, আর আমাদের জন্য দোয়া করবেন যাতে আমরা সফল হতে পারি। মায়ের কাছ থেকে পাঞ্জাবি, কোর্ট ফাইল ও চাদর ইত্যাদি নিয়ে আমি ও মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান ফকির রাতে শুয়ে পড়ি। কিন্তু অপারেশনের টেনশনে ঘুমাতে পারিনি। শুধুমাত্র সকাল হবার প্রহর গুণছি। এক ফাঁকে সকাল হয়ে গেল। আমরা চা-নাস্তা খেয়ে অপারেশনের জন্য ৪টা গ্রেনেড ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে মহান আল্লাহ্ পাকের নাম স্মরণ করে সকাল ৬টার সময় অপারেশনের উদ্দেশ্যে বের হই। প্রথম যাই মোগলটুলীতে আবদুর রহমান মাতব্বর বাড়ি অর্থাৎ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয়ে। রাস্তাঘাট অলি-গলি একেবারে ফাঁকা দেখতে পাই। পরিবেশ পরিস্থিতি থমথমে। আইস ফ্যাক্টরি রোড পার হয়ে যাওয়ার সময় পাকি হানাদার বাহিনীর কয়েকটি জিপ গাড়িকে দ্রুতগতিতে আমাদের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখলাম। কোনো পাকিহানাদার সে মুহূর্তে আমাদেরকে চার্জ করতো বা চেক করতো-- সেসময় নির্ঘাত আমাদের মৃত্যু ঘটতো।
আমি ফয়জুর রহমান ফকিরকে কিছুটা নার্ভাস দেখাচ্ছিল। তবে আমরা সাহস হারাইনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিকষ্টে ভয়ভীতিকে দূরে ফেলে কোর্ট বিল্ডিংয়ে পৌঁছি। দেখা গেল, কোর্টে কোনো মানুষজন নেই। আমরা সোজা কোর্ট বিল্ডিংয়ের তিনতলায় উঠে পড়ি এবং আমরা এবাদতের নিয়মমতে অবস্থান গ্রহণ করে মনে মনে ঠিক করতে থাকলাম, রাজকার পাণ্ডাদের মিটিংয়ে কীভাবে গ্রেনেড চার্জ করলে অধিক সফল হবো। এই ফাঁকে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কোর্ট বিল্ডিংয়ে কিছু লোক আসতে দেখা যায়। এর অল্প কিছুক্ষণ পরে পাকিহানাদার বাহিনী এসে কোর্ট বিল্ডিংয়ের সমস্ত এলাকা ঘেরাও করে ফেলে এবং গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে অবস্থান নেয়। তৎক্ষণাৎ পুলিশ ও কোর্টের কিছু কর্মচারী ও রাজাকারসহ সবাই মিলে সাধারণ লোকজনকে সরিয়ে দেয়। অল্পক্ষণ পরে জিপগাড়িযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল কুখ্যাত রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরী, মিয়াখান নগরের ধনা মিয়া ধন্যা ও আরো বেশ কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা রাজাকার গং হাজির হলো। এর পরক্ষণে জিপ গাড়িযোগে আবদুর নবী চৌধুরী ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতা এবং আরো অন্তত ১০ মিনিট পরে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ জামায়াত ও মুসলিম লীগে অন্যান্য নেতারা জিপ গাড়িতে করে এসে নামলো। তারা নামামাত্র পাকিসেনারা সালাম প্রদর্শন করলো। এসময় প্রাইভেট কারযোগে আসেন দেওয়ানহাটের পাকিস্তানি দালাল গরু সুলতান এবং ডবলমুরিং ফকিরহাট এলাকার কুলী সুলতান ও মুহুরী পাড়ার মুসলিম লীগ নেতা এম এ সালামসহ অন্যান্য নেতা। একই সঙ্গে পাকি সামরিক বাহিনীর কয়েকটি জিপ গাড়িযোগে বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পাকি আর্মি অফিসার আসেন।
তারা আসার অল্প সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে অবস্থিত জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মিটিং শুরু হয়ে যায়।
মিটিং শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমি ও ফয়জুর রহমান ফকির নিচে থাকা পাকিসেনাদের লক্ষ্য করে ২টি গ্রেনেড চার্জ করি। সাথে সাথে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে পুরো কোর্ট বিল্ডিং এলাকা বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে এবং কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ দ্রুতগতিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সভাস্থল লক্ষ্য করে আরও ২টি গ্রেনেড চার্জ করি। গ্রেনেড ২টি জোরালো শব্দে বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে মনে হয় চারপাশে ১/২ মিনিট একেবারে নীরব নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় এবং কালো ধোঁয়ায় কোর্ট বিল্ডিং এলাকা একেবারে অন্ধকার হয়ে যায়। এ অবস্থায় পাকি সেনারা ও রাজাকার নেতারা পড়ি-মরি দিগ্বিদিক ছোটাছুটি দৌঁড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। একপর্যায়ে আমরা ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং অন্যান্য রাজাকার নেতাদের ছোটাছুটি ও দৌড়াদৌড়ির সুযোগে তাদের লোক সেজে তাদেরই পেছনে পেছনে দ্রুতগতিতে ওপর থেকে নামতে শুরু করলাম। নামার সময় হঠাৎ ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আবদুল নবী চৌধুরী হুমড়ি খেয়ে পড়ে সিঁড়িতে গড়াতে থাকে। পরে যান সাকা’র বাপ ফকা চৌধুরীও। এসময় সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতগতিতে পালানোর সময় পেছন দিক থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পিতাকে না তুলে তার পিঠের ওপর পা রেখে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন।
তখন ফজলুল কাদের চৌধুরী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বলেন, “বাবা আমি ফজলুল কাদের চৌধুরী, আমাকে তোল। আমাকে ফেলে তোরা চলে যাসনে। ”
আঞ্চলিক ভাষায় ভয়ার্ত কণ্ঠে বলা ফকা’র কথাগুলো ছিল, “শেখ মুজিবের মুক্তিবাহিনী শালার পুতরা এসেছে এখানে। এন্ডে চলে আইচ্ছে। এন্ডে আইচ্ছে আঁরারে বোমা মারি দিয়ে। ওই সালাউদ্দিন এক্কানা তাড়াতাড়ি তোল। নইলে মুক্তিবাহিনী আঁরে মারি ফেলিব। ”
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পিতার শোর-চিৎকারে কান না দিয়ে নিজ জীবন বাঁচানোর জন্য দ্রুত পালিয়ে যায়। আমরাও তাদের অনুসরণ করে দ্রুত পালিয়ে আসি। পরে জানতে পারি, ওই অপারেশনে পাকিসেনা, রাজাকার, আলশামস, বদরবাহিনী এবং জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ নেতাসহ অনেকে গুরুতর আহত ও নিহত হয়। ওই অপারেশনের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর ইয়াহিয়া খান, পিপল্স পার্টির নেতা হার্মাদ জুলফিকার আলী ভূট্টো, জল্লাদ টিক্কা খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি দালালদের পরিকল্পনা একেবারে নস্যাৎ হয়ে যায়। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী, পাকি হানাদার বাহিনী আর পশ্চিম পাকিস্তানি দালাল রাজাকার, আলবদর, আলশামস তথা স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের মনোবল ও স্বপ্নসাধ একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।
মুক্তিযোদ্ধাদের এই সফল অপারেশনের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, জাপান, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। ওই খবর প্রচারিত হওয়ার পর রাতেই কমান্ডার ডা. মাহফুজুর রহমান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয় বিএলএফ কেসি-৩’এ এসে আমার কাছে অপারেশনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে জানতে চান।
আমি তাকে বিস্তারিত জানাই। ডা. মাহফুজুর রহমান সব শুনে আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন-- গরীব উল্ল্যাহ, তুমি এবং ফয়জুর রহমান এই দেশের, বাঙালি জাতির সত্যিকারের অহংকার, গর্ব। তোমাদের মতো যোদ্ধা এই বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছে বলেই আমরা বাঙালি জাতি ধন্য ও গর্বিত। যে জাতির এ ধরনের ইতিহাস নেই সেই জাতি কোনোদিন ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে না। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে সেই জাতিকে সীমাবদ্ধতার ভেতর অবস্থান করতে হবে। যে দেশে তোমাদের মতো যোদ্ধা জন্মগ্রহণ করবে না সে দেশের, জাতির ইতিহাসও কোনোদিন রচিত হবে না। তোমাদের মতো যোদ্ধা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে বাঙালি জাতির জন্য এতোবড় অবদান রেখেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি তোমাদের নাম জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে আমি মনে করি। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তোমাদের অশেষ ধন্যবাদ।
আনন্দে আমাদের অন্তর-আত্মা ভিজে ওঠে।
এর চেয়ে বড় সম্মান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর কী হতে পারে!
মো. গরীব উল্ল্যাহ মাতব্বর, মোতাওয়াল্লী, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা
কমান্ডার, ডবলমুরিং থানা কমান্ড, চট্টগ্রাম মহানগর সদর, সদস্য, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ
বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১২
একে