ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

পৌষে ঘুরে আসুন দিনাজপুর

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:৪৯, ডিসেম্বর ১৭, ২০১২
পৌষে ঘুরে আসুন দিনাজপুর

পৌষ থেকেই শুরু হয় শীতকাল। পৌষকে নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন- “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে, আয় আয় আয়/ ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়...।



এই শীতে উত্তরে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় বেড়াতে যেতে পারেন। একই সঙ্গে দেখে নিন ঠাকুরগাঁওকে। সবুজ শস্য ভাণ্ডার হিসেবে দিনাজপুরের খ্যাতি রয়েছে আজও। এক সময় ঠাকুরগাঁও আর পঞ্চগড়  দিনাজপুরের অধীন মহকুমা ছিল।

এই শীতে ভ্রমণে বের হলে একত্রে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও আর পঞ্চগড় দেখে নিন। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে যাওয়ার জন্য ট্রেন ও বাস রয়েছে। দিনাজপুরে যায় আন্তঃনগর ট্রেন একতা, তিস্তা আর দ্রুতযান।

ঢাকা টু দিনাজপুর সড়কপথে চলাচল করে হানিফ, শ্যামলী, নাবিল, বাবলু বিবিধ পরিবহন। ভাড়া  ৫০০ টাকা। দিনাজপুরে যাওয়ার আগে কিছু তথ্য জেনে নিলে ভালো হয়। এ জেলায় রয়েছে  ১১টি উপজাতির বসবাস।

খনিজ সম্পদে ভরপুর এ দিনাজপুর। দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা, আত্রাই, করতোয়া, পুনর্ভবা, দীপা, টাংগন বিবিধ নদী। উপজেলা ও থানা ১৩টি।

এগুলো হল- দিনাজপুর সদর, বিরামপুর, বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ, ফুলবাড়ী, হাকিমপুর, খানসামা, পার্বতীপুর, ঘোড়াঘাট, কাহারোল, বিরল, নবাবগঞ্জ ও চিরিরবন্দর। এখানে দর্শনীয় স্থান বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, রামসাগর, কান্তজীর মন্দির, চেহেল গাজীর মাজার, নয়াবাদ মসজিদ, ।

দিনাজপুর শহরে দেখবেন : চেহেল গাজীর মাজার, রামসাগর, রাজবাড়ি, আনন্দ সাগর, সুখ সাগর। রামসাগর দীঘি শুধু একটি দর্শনীয় ঐতিহাসিক কীর্তিই নয়- প্রাকৃতিক পরিবেশ, শোভা-সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

অনেককাল আগে থেকে সরস্বতী পুজো ও দুর্গাপুজোর বিসর্জন উপলক্ষে এখানে হয়ে আসছে বিরাট মেলা। তখন এই প্রান্তর হয়ে ওঠে মানুষের পদভারে মুখরিত। দিনাজপুরের মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫০ সালে এই দীঘি খনন করিয়েছিলেন।

পৌষ-মাঘে হাড় কাঁপানো শীত নামে বলে রামসাগর তীরে গরম পোশাক পরেই যাবেন। রাজবাড়িও দেখার মতো। রাজবাড়ির দালান-কোঠা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছিল রাজা গণেশের সময়ে। তাঁর রাজত্ব শুরু হয় ১৪০০ সালের প্রথম দিকে।

ভগ্নাবশেষ দালানগুলো দেখে অতীত যুগে ফিরে যাবেন। রাজবাড়ি দেখে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়বে গাছপালা। তখন হয়তো মনে পড়বে  “শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে/পাতাগুলি শিরশিরিয়ে সরিয়ে দিল তালে তালে...” কবিতার এই চরণগুলো।

কিংবা এ-ও মনে পড়তে পারে  “শিউলি-ফোটা ফুরোল যেই ফুরোল শীতের বনে এলে যে/ আমার শীতের বনে এলে যে সেই শূন্যক্ষণে...” কবিতার এই চরণগুলো।

রাজবাড়ির পাশেই সুখসাগর। সুখ সাগরে বেড়ানোর জন্য বোট পাবেন। এর পাড়ে শালবন। এখানেও যেতে পারেন। দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ১৩  মাইল উত্তরে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেপা নদীর ওপারের ছায়াঢাকা মায়ামাখা কান্তনগর গ্রামখানি।

ওখানে গিয়ে দেখুন ‘কান্তজীর মন্দির‘। এ মন্দিরটি ১৭৩২  সালে দিনাজপুরের জমিদার প্রাণনাথ পোড়ামাটি আর ইট দিয়ে নির্মাণ শুরু করেন। নির্মাণ কাজ শেষ হয় প্রাণনাথের ছেলে রমানাথের সময়ে অর্থাৎ ২০ বছর পর ১৭৫২  সালে।

টেরাকোটা অলঙ্করণের বৈচিত্র ও ভাস্কর্য কৌশল, স্থাপত্য সৌন্দর্য, শিল্প মহিমা এবং আয়তনে এর সমকক্ষ আর কোনো মন্দির বাংলাদেশে নেই। এর উচ্চতা ৭০ ফুট। এই মন্দিরে প্রবেশের জন্য চারদিকেই খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে।

দরজাগুলোর ওপর বাইরের দেয়ালে চারপাশের মতো অসংখ্য চিত্রফলক ইটের ওপর কারু কাজ করা হয়েছে। চিত্রগুলোতে বীরত্বগাথা ও অতীত ঘটনাবলী ধরে রাখা হয়েছে। এসব দেখে মুগ্ধ না হয়ে কি পারবেন? তখন হয়তো মনে পড়বে কবিগুরুর লেখা  ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে/ ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ/ দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাট নেত্র আগুন বরণ/ ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখিরে...‘ গানের এই কথাগুলো।

দিনাজপুর দেখা শেষ করে ঠাকুরগাঁও যাবেন। দিনাজপুর থেকে সড়ক পথে বাসে ঠাকুরগাঁও যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। রাত যাপন করার জন্য এখানে সালাম ইন্টারন্যাশনাল হোটেল রয়েছে। ওদিকে দিনাজপুরে রাত যাপনের জন্য আছে পর্যটনের মোটেল, কণিকা হোটেল, ডায়মন্ড হোটেল।

ঠাকুরগাঁও গিয়ে প্রবল আনন্দ পাবেন। ওখানের সর্বত্রই সবুজ-শ্যামল রূপ। বাংলাদেশের উত্তর জনপদের হিমালয় পাদদেশে শীতল পরশে লালিত এই ঠাকুরগাঁও জেলা। এখানে যেদিকে তাকাবেন, দেখবেন  প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য। ঠাকুরগাঁও জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে টাংগন ও নাগর নদী।

এই জেলায় রয়েছে ৬টি উপজেলা ও থানা। তা হলো ঠাকুরগাঁও সদর, হরিপুর, পীরগঞ্জ, বালিয়াডাঙ্গী, রুহিয়া ও রানীশংকৈল। ঠাকুরগাঁওয়ের দর্শনীয় স্থান হলো   খোচাবাড়ি বলাকা উদ্যান, টাংগন ব্রিজ, শেনুয়া ব্রিজ, চিনির কল, রানীশংকৈলে টংকনাথের বাড়ি।

এছাড়াও আছে-  গোরক্ষনাথ মন্দির, হরিপুর রাজবাড়ি, রাজা জগেন্দ্র নারায়ণের রাজবাড়ি, রাজা গণেশের রাজবাড়ি, জগদ্দল রাজবাড়ি, বাংলাঘর, সনগাঁও শাহি মসজিদ, সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের মাজার, গোবিন্দ জিউ মন্দির, হরিপুর শিব মন্দির, রামরাই দীঘি, শ্যামরাই মন্দির, ফতেপুর মসজিদ বিবিধ।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জামালপুর গ্রামের ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি দেখতে গিয়ে ওখানের মসজিদটিও দেখে নিন। কারুকার্যময় এ মসজিদটি ২’শ বছরের পুরনো। এর স্থাপত্যশৈলী অত্যন্ত সুন্দর। মসজিদটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো চারপাশের সুদৃশ্য মিনার ও তার নকশা।

এটি শুধু দেখা নয়, এখানে যাওয়ার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবির পর ছবি তুলুন। মসজিদটি দেখে যখন গাঁয়ের পথ ধরে ঠাকুরগাঁও ফিরবেন তখন দেখবেন প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্য। তখন মনে দোলা দেবে ‘বকুল বনের মুগ্ধ হৃদয় উঠুক না উচ্ছবাসি/ নীলাম্বরের মর্ম-মাঝে বাজাও তোমার সোনার বাঁশি বাজাও/ পলাশরেণুর রঙ মাখিয়ে নবীন বসন এনেছি এ/ সবাই মিলে দিই ঘুচিয়ে/ পুরনো আচ্ছাদন, তোমার পুরনো আচ্ছাদন...’  গানের এই কথাগুলো।
 
ঠাকুরগাঁও দেখা শেষ করে যাবেন পঞ্চগড়ে। সড়কপথে বাসে ঠাকুরগাঁও থেকে পঞ্চগড় যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। পঞ্চগড় বেড়াতে যাওয়ার আগে কিছু তথ্য জেনে নেয়া ভালো। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বলে পঞ্চগড় জেলা হিমালয়কন্যা নামেও পরিচিত। এ জেলা পাঁচটি গড়ের সমষ্টি, যেমন- মীরগড়, ভিতরগড়, রাজগড়,  হোসেনগড় ও বোদ্ধেশ্বরীগড়।

ধারণা করা হয়- পাঁচটি গড়ের সমষ্টি থেকেই পঞ্চগড় জেলাটির নামের উৎপত্তি হয়েছে। ৫টি উপজেলা ও থানা নিয়ে পঞ্চগড় জেলা। যেমন পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া, অটোয়ারি, বোদা ও দেবীগঞ্জ।

এখানে দর্শনীয় স্থান-  বোদেশ্বরী মন্দির, চা-বাগান, তেঁতুলিয়া, বাংলাবান্ধা, নয়নী বুরুজ, অটোয়ারি রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, দেবীগঞ্জের দেবোত্তর এস্টেট, কাছারিবাড়ির ধ্বংসাবশেষ ও মন্দির, মির্জাপুর শাহি মসজিদ, মোঘলী কেল্লা, মহারাজার দীঘি, ময়দান দীঘি, বারো আউলিয়ার মাজার, জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় গেলে নির্জনতা খুঁজে পাবেন। পড়ন্ত বিকালে এখানের মহানন্দা নদীর তটে বসে দারুণ আনন্দ অনুভব করা যাবে। মহানন্দার ওপারেই তো ভারত। এদিকে যদিও বা সন্ধ্যা নেমে আসে তাহলে তো আরেক রূপ খুঁজে ফিরবেন।

প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তবুও মনোলোভা মহানন্দা নদী তটে বসে কত না কথা ভাববেন। তখন কী মনে পড়বে না ‘এই আসা-যাওয়ার খেয়ার কূলে আমার বাড়ি/ কেউ বা আসে এপারে, কেউ পারের ঘাটে দেয় রে পাড়ি/ পথিকেরা বাঁশি ভরে যে সুর আনে সঙ্গে করে/ তাই যে আমার দিবানিশি সকল পরান লয় রে কাড়ি...’  গানের এই কথাগুলো!

তেঁতুলিয়ায় শুধু মহানন্দার রূপেই মুগ্ধ হবেন না, ওখানে প্রকৃতির রূপেও মজে যাবেন। মহানন্দার তীরে টিলার ওপর ডাকবাংলোটি দেখে অভিভূত হবেন। ডাকবাংলো সংলগ্নে দেখবেন একাত্তরের বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত একটি বেদি।

এরই দক্ষিণ পাশে পিকনিক কর্নার। তেঁতুলিয়ার যেদিকে যাবেন সেদিকটিই কিন্তু মনোরম। ওখানে গিয়ে মনে হবে  ‘সোনা ঝরায় আকাশ আর সোনা ফলায় মাটি/ আহা আমার সোনার দেশ/ এই মাঠের মানুষ মাঠে আর সোনার ফসল কাটায়’  গানের এই কথাগুলোও।

শেষ কথা : দিনাজপুরে প্রথম গিয়েছিলাম ১৯৭৪ সালে। তখন তো আন্তঃনগর ট্রেন ছিল না। মেল ট্রেনে বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে স্টিমারে ওপারে ফুলছড়ি ঘাটে নেমে তারপর আবার ট্রেনে উঠতে হতো। সময় লেগেছিল ২২ ঘণ্টা। ওখানে ৪ দিন থেকেছিলাম।

আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়া মিলে খরচ হয়েছিল ১১০ টাকা। পৌষে গিয়েছিলাম বলে দিনাজপুরের বড় মাঠে দাঁড়িয়ে দূরের হিমালয়কে দেখেছিলাম আবছা মেঘের মতো।

তারপর দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের রূপ ও সৌন্দর্যের টানে এ পর্যন্ত ১০১ বার ওখানে যাওয়া। এবারের শীতে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও আর পঞ্চগড়ে বেড়াতে ইচ্ছুকরা কম করে হলেও ৫ দিন সময় নিয়ে যাবেন। এ ভ্রমণে কম করে হলেও জনপ্রতি খরচ পড়বে ৪ থেকে ৫  হাজার টাকা।

বাংলাদেশ সময় : ১৪৩৩ ঘন্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১২
লিয়াকত/সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।