ই-কমার্সের ধারণাটা বেশ পুরনো। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে এ ব্যবসার পরিধি বাড়ছে হু হু করে।
অনলাইনভিত্তিক এ বহুমুখী উদ্যোগে এগিয়ে আসাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় দেশের ই-কমার্স এখন টেকসই হচ্ছে। এমনই কয়েকটি উদ্যোগের কথা নিয়ে এ প্রতিবেদন-
রকমারি ডটকম:
অল্প দিনেই দেশে সফল হয়েছে রকমারি ডটকম (http://rokomari.com/)। শুধু বই বিক্রি করে দেশে অনলাইনে বিশ্বায়িত ব্যবসার চালু করার অগ্রদূত হয়েছে এ সাইট।
২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে রকমারি ডটকমের আত্মপ্রকাশ। বই বিক্রি দিয়ে ই-কমার্স শুরু করলেও ভবিষ্যতে ই-বুক, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ক্যামেরা ছাড়াও জীবনযাপনের সব ধরনের পণ্যের বিক্রি অচিরেই শুরু করবে বলে উদ্যোক্তার পক্ষে বাংলানিউজকে জানানো হয়।
রকমারি ডটকম বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে বই পৌঁছে দিতে সক্ষম। বই পড়ুয়াদের কাছে এ জন্যই রকমারি ডটকমের কদর বেড়েছে। তারা বাংলানিউজকে জানায়, বাংলাদেশে আমরাই প্রথম ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি। ফলে বই বাসায় পৌছার পর পাঠকদের পেমেন্ট করতে হবে। এ জন্য বইয়ের মূল্যের সঙ্গে গুণতে হবে বাড়তি ৩০ টাকা।
রকমারির প্রধান উদ্যোক্তা ও চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সোহাগ বাংলানিউজকে জানান, ই-কমার্স ব্যবসার শুরুতে অনেকগুলো সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে বই দিতে গেলেই আমাদের সমস্যা পোহাতে হয়েছে। বিশেষ করে রিয়েল টাইম ট্র্যাকিং সিস্টেম নেই। সুতরাং আমি প্রযুক্তিনির্ভর হলেও আমাকে যে বিষয়গুলো সাপোর্ট করবে সেগুলো প্রযুক্তিনির্ভর ছিল না।
তবে সোহাগ নিশ্চিত করে বলেন, বাংলাদেশে দিন দিন ইন্টারনেট গ্রাহক বাড়ছে। দেশের গণমাধ্যমগুলোও এ প্রচারে সার্বিক সহযোগিতা করছে। তবে সবকিছুর জন্য প্রয়োজন সময়। অনলাইন অর্ডার দিয়ে ঘরে বসেই পণ্য পাওয়া যায়। এ ব্যবসায় আস্থা অর্জন সবচেয়ে কঠিন শর্ত। এ বিষয়েও সচেতন হতে হবে। তবে নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি, বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসা জনপ্রিয় হবেই।
এ ছাড়াও এ সময়ের তরুণদের ই-কমার্স উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয় সম্পর্কে সোহাগ বাংলানিউজকে বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কোনো কিছু করতে গেলেই একটা হুজুগ আসে। অনেকে মনে করেন ওয়েবসাইট বানিয়েই ই-কমার্স শুরু করে দেওয়া যায়।
কিন্তু এটা আসছে সঠিক না। এ জন্য অর্থ প্রয়োজন। আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়া কেউ যদি এ ব্যবসায় নামে তবে ই-কমার্স বাজারটা নষ্ট হয়ে যাওয়ারও শঙ্কা আছে। কারণ ব্যবসায় নেমে তারা হতাশ হয়ে পড়বে। তাদের দেখে ভালো নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না।
রকমারি ডটকম তাদের শুরুতে মাত্র ছয়জন কর্মী নিয়ে শুরু করে। এ মুহূর্তে কাজ করছেন ৪২ জন কর্মী। শুধু বই বিক্রি করে এ উদ্যোগ সফলতার প্রান্তে পৌছে গেছে।
আমার দেশ আমার গ্রাম:
২০০৬ সালে লন্ডনে আতাউর রহমান ও সাদিকা হাসান সেজুতি ছাড়াও কয়েকজন বন্ধু মিলে লন্ডনে শুরু করে ই-কর্মাসনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান। নাম দেওয়া হয় ‘ফিউচার সলিউশন ফর বিজনেস’। এখানে সফলতার সঙ্গে ব্যবসাকে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা পণ্য কেনাবেচার কাজ শুরু করেন। খুব কম সময়ে সফলও হন।
কিন্তু হঠাৎ দেশের জন্য কিছু করার আগ্রহ তৈরি হয়। বিদেশে বসে বসে টাকা উপার্জনের চেয়ে দেশের জন্য কিছু করার আকাঙ্খাই মুখ্য হয়ে ওঠে। যেমন কথা, কাজও তেমন। দেশে ফিরে আসলেন।
আতাউর-সাদিকার নেওয়া ই-কমার্সভিত্তিক ‘আমার দেশ আমার গ্রাম’ (http://amardeshamargram.com/) প্রকল্প শুধু সাফল্য পেয়েই ক্ষান্ত হয়নি। পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও।
এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা সাদিকা হাসান সেজুতি বলেন, শুরুতে ভয় ছিল। কিন্তু স্থানীয় মানুষগুলো আগ্রহ নিয়েই আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। খেয়াল করলাম মংলার অধিকাংশ নারীরাই নকশীকাঁথা সেলাই করে। তখন নকশীকাঁথার ছবি তুলে একটা দাম নির্ধারণ করে ওয়েবসাইটে তুলে দেই। দামের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় যুক্ত হয়। যেমন গ্রাহকের সুন্দরবন সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠালে সেটার দাম ধরা হয় এবং মূল দামের ১৫ ভাগ অর্থ বেশি নেওয়া হয়।
কারণ সেখানে বসে যেসব ছেলেমেয়েরা কাজগুলো করবে তাদের জন্য সম্মানি থাকে। এতে করে স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে। এ মুহূতে বাংলাদেশের ১৩টি উপজেলায় ‘আমার দেশ আমার গ্রাম’ প্রকল্পের ই-শপ চালু আছে। এসব ই-শপে চলছে স্থানীয়দের সহায়তায়। এমনকি ই-শপের জন্য যে জায়গা প্রয়োজন হয় তাও স্থানীয়রা দিয়েছেন।
আমার দেশ আমার গ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিকা হাসান সেজুতি বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক প্রদর্শনী অনলাইনেই করতে যাচ্ছি। বানিজ্যিক প্রদর্শনীতে যত প্রতিষ্ঠানের স্টল হবে তাদের জন্য পণ্য অনলাইন বিক্রয় করা সহজ হবে। এ জন্য আপনাকে (www.ditfeshop.com) সাইটে যেতে হবে।
ই-কমার্সের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে সেজুতি বলেন, বাংলাদেশ অনুযায়ী ই-কমার্স বেশ ভালো এগোচ্ছে। চার বছরে আমরা অনেকটাই এগিয়েছি। আগে তো বড় প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বোঝাতে হতো ওয়েবসাইট কি? কিন্তু ভেবে দেখুন, এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও বোঝে ওয়েবসাইট আসলে কি। সুতরাং সমস্যা থাকলেও তরুণদের উদ্যোগে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
আমাদের দেশে অসংখ্য ই-কমার্স সাইট তৈরি হচ্ছে। এ আইডিয়া থেকে বের হয়ে ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করতে হবে। যেমন আমি নক্সিকাথা বিক্রি করছি। কিন্তু কেউ বিক্রি করছে বই। একটা কমন প্ল্যাটফর্ম হলে দুজনই সেখানে থাকতে পারি। তখন এটা আরও প্রসার পাবে। একটা সাইটে ঢুকলে সবাই তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য পেয়ে যাবে।
এখনই ডটকম:
বাংলা ভাষায় তৈরি দেশের প্রথম ই-কমার্স ও ডিল ওয়েবসাইট হলো এখনই ডটকম (http://www.akhoni.com/dhaka)। অন্য ই-কমার্স সাইটগুলো থেকে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিদিন আকর্ষণীয় পণ্যের ওপর বিশেষ মূল্যছাড়ে কেনাকাটা করা যায়। দেশের স্বনামধন্য নানা প্রতিষ্ঠানের খাবার, ভ্রমণ, বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও অন্য সব সুবিধা গ্রহণ করা যাবে এ সাইটের মাধ্যমে।
এখনই ডটকম সাইটকে ‘ডিল সাইট’ হিসেবেও বলা যায়। কারণ এখানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার নিত্যনতুন অফার পাওয়া যায়। পণ্যের বাজার দরের চেয়ে অনেক কম দামে, বিশেষ ছাড়ে এখনই ডটকম থেকে যে কেউ ইচ্ছা মত পণ্য কিনতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে এখনি ডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আহসান বাংলানিউজকে বলেন, শুরু যখন করলাম তখন ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট নিয়ে অনেক সমস্যা ছিল। ক্রেতারা ভাবছে সমস্যাটা আমাদের। কিন্তু আসলে এটা ব্যাংকের সমস্যা।
কুরিয়ার করে যে প্রতিষ্ঠানে তাদের আধুনিকায়নের একটা প্রসঙ্গ চলেই আসে। তবে ই-কমার্সের স্বার্থেই তাদের আমরা তৈরি করে নিচ্ছি।
ভবিষ্যতে ই-কমার্সের প্রসঙ্গে শামীম আহসান বলেন, সত্যি কথা বলতে সামনের সময়ে দু থেকে তিনটা সাইট বাজারে টিকে থাকবে। বাকিগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তবে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। এ বিষয়টি নিয়ে সবার ভাবার সময় এখনই।
তরুণ উদ্যোক্তা সম্পর্কে শামীম আহসান বলেন, আমরা চাই তরুণ উদ্যোক্তা এগিয়ে আসুক। তবে একটা ছাতার নিচে আসা প্রয়োজন। আমাদের সাইটেই ‘ই স্টোর’ চালু করেছি। এটাকে আপনি অনলাইন মার্কেট বলতে পারেন।
এখানে যে কেউ দোকান দিতে পারবেন। ই-শপে আপনার পণ্য নিয়ে আপনি নিজেই হাজির হতে পারেন। মাসে কিছু টাকা দিয়ে এ ই-স্টোরে যে কেউ থাকতে পারেন। কারণ হচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা কয়েক জনের থাকে? আর থাকলেও সাইটকে জনপ্রিয় করা অনেক কঠিন। এক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সাইটে সবাই থাকলে ভোক্তাদের এবঙ উদ্যোক্তা উভয়েরই বাগতি সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন।
রূপকথা ডটকম:
ঐহিত্যবাহী ঢাকাই জামদানির নিত্যনতুন সব ডিজাইনের শাড়ি, সেলোয়ার কামিজ, ওড়না এবং পাঞ্জাবী পাওয়া যাচ্ছে অনলাইন স্টোরে।
রূপকথার উদ্যোগে শুরু হয়েছে জামদানির জন্য বিশেষ এ অনলাইন স্টোর। রূপকথার প্রধান উদ্যোক্তা শারমীন রাবেয়া বাংলানিউজকে জানান, বাংলার ঐতিহ্যের ইতিহাস, বাঙালির নিজস্বতা আছে একমাত্র জামদানিতে। জামদানি কিনতে ঢু মেরে দেখতে পারেন(http://rupkothajamdani.com) এ সাইটে।
নিজের ভিন্ন ধরনের এ উদ্যোগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শারমীন বলেন, সবাই বুটিক হাউজ নিয়ে ভাবে। এমনকি অন্য সব ই-কমার্স সাইটগুলোতে হরেক রকমের পণ্য থাকে। কিন্তু আমি একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েই ভেবেছি।
এ ছাড়াও তিনি বলেন, একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
পরিবারের বাধা থাকা সত্ত্বেও করছি। কিন্তু একটু একটু সফলতায় তারা এখন আমার কাজটি বোঝে। এ ছাড়া বাকি যে সমস্যাগুলো আছে তা থেকেও সময়ের সঙ্গে উত্তরণ ঘটবে বলে আমি আশা করছি।
আর্থিক লেনদেন বিকাশে কিংবা সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে করার সুবিধা আছে বলে রূপকথা জামদানি জানিয়েছেন। এ ছাড়াও ক্যাশ অন ডেলিভারির সুযোগও আছে।
বাংলাদেশ সময় ১৮২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১২
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর