আগ্রা ঘুরে এসে: আগ্রায় তাজমহলের সামনে যখন নান্টু মিয়া পৌঁছালো তখন বিকেল তিনটা। চারটার পর আর তাজমহলে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
নান্টু মিয়া ভারতীয় নন। তবে চেহারায় ভারতীয় ছাপ স্পষ্ট। হিন্দি বুঝতে পারেন, কিন্তু বলতে পারে না, ইংরেজিতেও যে খুব দক্ষ তাও নয়, তবে কথা চালানো যায়।
কথায় কথায় তিনি জানান বেশ কয়েকদিন ধরেই আছেন ভারতে। হিন্দি ভাষাভাষীদের সঙ্গে আলাপে যে কোনো শব্দের শেষে ‘হে’ প্রত্যয় যোগ করে ভাষাকে হিন্দিতে অনুবাদের চেষ্টা করছেন নান্টু।
এ কয়দিন কলকাতা, নয়াদিল্লি, আজমির আর জয়পুর ঘুরে ভারতীয়দের কাছে খুব বেশি পাত্তা পাননি ৪৫ বছরের নান্টু। বাড়িতে বৌ-বাচ্চাকে বলে এসেছে বিদেশ যাচ্ছেন।
ভারতের মাটিতে পা দিয়ে বিদেশি বিদেশি ভাব নিলেও কলকাতা থেকে আগ্রা কোথাও ভারতীয়রা বেশি পাত্তা দেয়নি তাকে। ধবধবে সাদা পর্যটকগুলোকেই কেবল মাথায় তুলে রাখে ভারতীয়রা। তাদের দেখলে রাস্তা ছেড়ে দেয় আর নান্টুকে দেখলে পথ আটকে দেয়।
কুচকুচে কালো লোকগুলোকেও সমাদর করে ভারতীয়রা। বোঝা যায়, এরা ট্যুরিস্ট, তাদের খাতির করতেই হবে।
যতই কাঁধে ব্যাগ ঝোলাক আর চোখে ‘সানগ্লাস’ পরুক নান্টু মিয়া আর ট্যুরিস্ট রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না ভারত ভূখণ্ডে। এ কয়দিন মাঝে মাঝেই ভেবেছেন ‘হায় খোদা, এ কি রং দিলে শরীরের। হয় একদম সাদা করতে, নইলে কুচকুচে কালো। ’ নান্টু মিয়া ভাবেন, যাই হোক ভাব কমানো যাবে না।
তাজমহলে প্রবেশের জন্যে টিকিট সংগ্রহের লাইনে দাঁড়ায় নান্টু মিয়া। কর্তৃপক্ষ বলতে থাকে, যেন বিদেশিরা আলাদা লাইনে দাঁড়ায় এবং আলাদা টিকিট সংগ্রহ করে। দৌড়ে এসে আলাদা লাইনে দাঁড়ান নান্টু। ভারতীয় লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর দিকে এমনভাবে তাকান যে, ‘দেখে রাখো, দেখতে তোমাদের মতো হলেও, আমি আসলে বিদেশি। না হলে এ লাইনে দাঁড়াতে পারতাম না। পারলে এসে দাঁড়াও। ’
অবজ্ঞার দৃষ্টিতে ভারতীয়দের দিকে তাকায় নান্টু মিয়া। কিন্তু টিকিট কাউন্টারে ঝোলানো বোর্ডটির দিকে দৃষ্টি পড়তেই পেটের মধ্যে খামচি মেরে ওঠে, ‘‘হায় হায় কী বলে! বিদেশি হিসেবে না হয় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা গেল। কিন্তু তার বদলে ভারতীয়দের থেকে ৪৯০ রুপি বেশি গুনতে হবে নান্টুকে! হায় ঈশ্বর, এ কোন কপাল, বিদেশি হলেও বিপদ! ভারতীয়দের জন্যে টিকিট ২০ রুপি আর বিদেশিদের জন্যে ৫১০ রুপি!
সরকারি টাকায় কোনো রকমে বিদেশ সফরে এসেছেন নান্টু মিয়া। সবাইকে বিজ্ঞাপন করে এসেছেন, তাজমহল দেখতে যাচ্ছেন। এদিকে, যা কয়েক রুপি ছিল, বেশ কয়েকদিন ঘুরে তাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। মাথায় হাত নান্টু মিয়ার। চোখের সামনে ভাসে তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হচ্ছে তার, যে স্বপ্ন এতোদিন ধরে দেখে আসছিলেন তিনি। বাইরে থেকে যদি শ্বেতস্থাপত্যের কোনো অংশ দেখা যেত, তাও হতো। ছবি তুলে বলা যেতো, দেখে এসেছি। কিন্তু সে অবস্থাও নেই।
নাহ আর ভারতীয়দের সঙ্গে নিজেকে আলাদা করে লাভ নেই। নান্টু মিয়ার দেশের কথা মনে পড়ে। সে দেশের লোকের নাকি অনেক বুদ্ধি। আজ দেশের নাম রাখতে হবে।
ভারতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে নান্টু মিয়া। হালকা হিন্দিতে এক ভারতীয় যুবককে বলেন, ‘ভাইছাব ওয়ান মোর টিকেট কাটতেহু...’ যাই বলুক যুবক তা বুঝতে পারে। নান্টু মিয়াকে কিনে দেন ২০ রুপির একটি টিকিট। টিকিট পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পান নান্টু মিয়া এমন ভঙ্গিতে টিকিট নিয়ে টগবগিয়ে তাজমহলের প্রবেশ ফটকের দিকে দৌড়ান।
হায় খোদা! ভেতরে প্রবেশের সময় ভারতীয়দের লাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র চেক করা হচ্ছে। এদিকে সময়ও বেশি নেই। মন খারাপ হয়ে যায় নান্টু মিয়ার। চুপ করে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করতে থাকেন। মাথায় বিদ্যুতের মতো হটাৎ এক বুদ্ধি খেলে যায়।
পাশের একটি সিগারেটের দোকানে গিয়ে ধোঁয়া উৎপাদন শুরু করেন নান্টু মিয়া। এরই মধ্যে বিকাশ নামে এক ভারতীয় ধূমপায়ী যুবকের সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে ফেলেন। কথায় কথায় জানা যায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ তরুণ। নান্টুর সমস্যার কথা শুনে সে জানায় তার কাছে, জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র রয়েছে।
বিকাশের জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে তাজমহলের গেটের দিকে এগিয়ে চলে নান্টু মিয়া। এটুকু সাহস না থাকলে কি আর পানিপথের যুদ্ধে নামা যায়!
পরিচয়পত্র ভালোমতো খতিয়ে দেখা হয় না। চোখ বুলিয়েই ছেড়ে দেওয়া হয়।
সত্যি অনন্য সুন্দর! তাজমহল দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় নান্টু মিয়ার। আনমনেই হেসে ওঠেন তিনি। ইচ্ছে করে তাজমহলটাকে কোলে নিয়ে কতক্ষণ লাফাতে পারলে যেন তার সাধ পূর্ণ হতো।
ফটোগ্রাফাররা এসে বিভিন্ন স্যাম্পল দেখাতে থাকে, কত ধরনের ছবি তোলা যায়। এমনভাবে ছবিগুলো তোলা যে কোনোটায় তাজমহল হাতের ওপর, কোনোটায় নিচে। ছবিগুলোর বেশিরভাগ মডেলই সাদা চামড়ার। নিজের চামড়ার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির হাসি ফোটে নান্টুর ঠোঁটে।
একজনকে ভাড়া করে নিয়ে ‘মাথায় তাজমহল’ গোছের দুটি ছবি তোলেন তিনি। গোঁফ যেন ভালো মতো ফুটে ওঠে, সে নির্দেশনা দেওয়া হয় ফটোগ্রাফারকে।
তাজমহলের মূল স্থাপত্য থেকে ২০০ মিটার দূরে একটি উচুঁ জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তোলা যায় ভালো। সেখানে ভারতীয় আর বিদেশিদের ধাক্কা দিয়ে জায়গা করে নেয় নান্টু মিয়া। জোর করে মুখ ভর্তি হাসি মাখা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে যান তিনি।
এবার মূল স্থাপনা ‘সমাধি’তে ওঠার পালা। কিন্তু বিধি বাম! এখানে বিদেশিদের জন্যে যে পথ সেখান দিয়ে তাড়াতাড়ি প্রবেশ করা যায়। ভারতীয়দের ঘুরে যেতে হয়। হাতে সময়ও বেশি নেই। বিদেশিদের প্রবেশ পথে যে সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে চমৎকার ইংরেজি বলেন নান্টু মিয়া। মনে হয় লন্ডন থেকে তাজমহলের সামনে মাত্র ল্যান্ড করেছেন। ভড়কে গিয়ে দ্রুত পথ ছেড়ে দেয় গার্ড।
মূল স্থাপনায় প্রবেশ করেন নান্টু। সঙ্গে থাকা ফটোগ্রাফারই ভূমিকা নেয় গাইডের।
ফটোগ্রাফার শোয়েব জানান, মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ নামে পরিচিত, তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটি নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে, যা সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে।
কানের সামনে ভাঙা রেকর্ডারের মতো শোয়েবের কথা বাজা শুরু করলো। শোয়েব জানালো, তাজমহল মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় নিদর্শন। নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। যদিও সাদা মার্বেলের গম্বুজ আকৃতির রাজকীয় সমাধীটিই বেশি সমাদৃত।
তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে একটি জটিল অখণ্ড স্থাপত্য। ১৯৮৩ সালে একে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
মাজার অংশ, দরজার মাঝামাঝি অংশে এবং বাগানের মাঝখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো আছে এবং উত্তর- দক্ষিণে আছে একটি সরলরৈখিক চৌবাচ্চা যাতে তাজমহলের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। এছাড়া বাগানে আরও বেশ কিছু বৃক্ষশোভিত রাস্তা এবং ঝরণা আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে নান্টু বেশ কিছু ছবি তুলেছেন।
মূল চত্বরে উঠে দাঁড়ান নান্টু মিয়া। মুখে বিজয়ীর ভাব চলে আসে। ভাঙা রেকর্ডার থেকে বের হয়- তাজমহলের চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মত দেয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে ঘেরা। নদীর দিকের পাশটিতে কোন দেয়াল নাই। এই দেয়াল বেষ্টনির বাইরে আরও সমাধি রয়েছে যার মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি এবং মমতাজের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড় সমাধি রয়েছে। এ স্থাপত্যসমূহ প্রধানত লাল বেলে পাথর দ্বারা তৈরি, দেখতে সেসময়কার ছোট আকারের মুঘল সাধারণ সমাধির মতন।
এবার মূল স্থাপত্য। যেখানে মাজার। তাজমহলের মূলে হলো তার সাদা মার্বেল পাথরের সমাধি, যা অন্যান্য মুঘল সমাধির মতো মূলত পারস্যদেশীয় বৈশিষ্ট্য, যেমন আইওয়ানসহ প্রতিসম ইমারত, একটি ধনুক আকৃতির দরজা, উপরে বড় গম্বুজ রয়েছে। সমাধিটি একটি বর্গাকার বেদিকার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভিত্তি কাঠামোটি বিশাল এবং কয়েক কক্ষবিশিষ্ট। প্রধান কক্ষটিতে মমতাজ মহল ও শাহজাহানের স্মৃতিফলক বসানো হয়েছে, তাদের কবর রয়েছে এক স্তর নিচে।
নান্টুর স্ত্রীর বয়স এখন ৪০ পেরিয়েছে। তরুণ বয়সের সে প্রেম এখন আর নেই। দেখতে আগের মতো সে স্ত্রীকে সুন্দরীও মনে হয় না তার। কিন্তু এখানে এসে ২০ বছরের সঙ্গীনির কথা মনে পড়ে নান্টুর। ইচ্ছে হয়, নিজেও যদি এরকম একটা বানাতে পারতেন....
আবারো শোয়েব, নকশাটি সম্পূর্ণভাবে প্রতিসম এবং ইমারতের প্রতিটি দিকেই একই রকম। চারটি মিনার রয়েছে, ভিত্তির প্রতিটি কোণায় একটি করে মিনার, ভাঙ্গা কোণার দিকে মুখ করে রয়েছে।
সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের গম্বুজই সমাধির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। গম্বুজের উপরের দিক সাজানো হয়েছে একটি পদ্মফুল দিয়ে, যা তার উচ্চতাকে আরও দৃষ্টি গোচড় করে।
বড় গম্বুজটির গুরুত্বের কারণ এর চার কোণায় আরও চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। ছোট গম্বুজগুলোও দেখতে বড় গম্বুজটির মতই। এদের স্তম্ভগুলো সমাধির ভিত্তি থেকে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। ছোট গম্বুজগুলোতেও কাসা বা তামার পুরনো দণ্ড আছে।
লম্বা মোচাকার চূড়া বা গুলদাস্তা ভিত্তি দেয়ালের পাশ দিয়ে উপরে উঠেছে এবং গম্বুজের উচ্চতায় দৃষ্টিগোচর হয়। বড় গম্বুজের ওপর মুকুটের মতো একটি পুরনো মোচাকার চূড়া রয়েছে। চূড়াটি ১৮০০ শতকের আগে স্বর্ণের নির্মিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে এটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি।
সমাধির চার কোনায় যে মিনারগুলো রয়েছে সেগুলো বেদির থেকে বাইরের দিকে কিঞ্চিৎ হেলানো আছে, যাতে এ মিনার কখনও ভেঙে পড়লেও যেন তা মূল সমাধির উপরে না পড়ে।
শোয়েবের শেষ কথাগুলো শুনে নিজের ১৭ বছরের ছেলে বিন্টুর মুখ ভেসে আসে নান্টুর মাথায়। কি ভয়ংকর কথা! তাজমহলের নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই শাহজাহান তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেব দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও আগ্রার কেল্লায় গৃহবন্দী হন। কথিত আছে, জীবনের বাকি সময়টুকু শাহজাহান আগ্রার কেল্লার জানালা দিয়ে তাজমহলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই কাটিয়েছিলেন।
নাহ নান্টু তো আর রাজা নয়। আর নিশ্চয়ই বিন্টু খারাপ হবে না। শাহজাহানের মৃত্যুর পর আওরঙ্গজেব তাঁকে তাজমহলে তাঁর স্ত্রীর পাশে সমাহিত করেন, তবে একমাত্র এ ব্যাপারটিই তাজমহলের নকশার প্রতিসমতা নষ্ট করেছে।
১৯ শতকের শেষ ভাগে তাজমহলের একটি অংশ মেরামতের অভাবে খুব খারাপভাবে নষ্ট হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজ সৈন্যরা তাজমহলের বিকৃতি সাধন করে আর সরকারি কর্মচারীরা বাটালি দিয়ে তাজমহলের দেয়াল থেকে মূল্যবান ও দামি নীলকান্তমণি খুলে নেয়।
ততক্ষণে সন্ধ্যা প্রায়। স্ত্রীর জন্যে ১০০ রুপি দিয়ে একটি শ্বেত পাথরের তাজমহল কিনে নেয় নান্টু মিয়া। এখানে পাথরের মূল্য বেশ কম।
মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখল নান্টু। আজ ১২ ডিসেম্বর, অর্থাৎ ১২/১২/১২
রাত হয়ে গেছে। বাইরে থেকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না তাজমহল। মনে মনে হাসে নান্টু মিয়া। অনেক টাকা থাকলে আর পাথরের দাম কম হলে সেও একটি বানাতে পারতো।
বাংলাদেশ সময় ১১৩৪; ডিসেম্বর ২৮, ২০১২
এমএন