ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

জেলের দেয়াল ভেঙে দিলেন পুষ্প!

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৫২, জানুয়ারি ২, ২০১৩
জেলের দেয়াল ভেঙে দিলেন পুষ্প!

চল্লিশজন শিক্ষার্থী নিয়ে পুষ্পর স্কুল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকেই উঠেই চলে যান একঝাঁক শিশুদের কাছে।

নিজ হাতে স্কুলের কাপড় পরিয়ে দেন। নাস্তার ব্যবস্থা করেন। তারপর সবাইকে নিয়ে রওনা দেন স্কুলের পথে।

প্রতিদিন তার একই রুটিন। একইভাবে পুষ্প বাসনেত পার করছেন এ জীবন। শিশুদের জন্যই নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে ২০১২ সালের ‘সিএনএন অব দ্য ইয়ার’ সম্মানে ভূষিত  হলেন ২৮ বছরের নেপালী এ তরুণী।

পুষ্প কি করছেন আসলে? এমন প্রশ্ন সবার মনে আসতেই পারে। শুরুতেই পরিচয় করিয়ে দিই। পুষ্প বাসনেত নেপালের কারাগারের ভেতরে থাকা শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন।

পৃথিবীর মানচিত্রে নেপাল অত্যন্ত ছোট ও দরিদ্র এক দেশ হিসেবেই পরিচিত। ইউনিসেফেরে হিসাবে নেপালের ৫৫ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। শিশুরা সে দেশে সুযোগ সুবিধা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত।

এমনই একটি দেশে সংগ্রাম করছেন পুষ্প। তিনি একদিন শুনলেন নেপালের বিভিন্ন জেলে প্রায় অসংখ্য শিশু অবস্থান করছে। এর কারণ সন্ধানে নেমে পড়েন পুষ্প। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, কারগারে অনেক আসামীর সন্তানদের বয়স কম। তারা (আসামী) ছাড়া আর কেউ নেই যারা এ শিশুদের দেখভাল করবেন। ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত হয় নিজ নিজ সন্তানদের নিয়েই আসামীরা কারাগারে অবস্থান করবেন।

এ বিষয়টি পুষ্পকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, একটা শিশু কেন জেলে থাকবে? তার তো কোনো দোষ নেই। ছোটবেলাতেই জেলের মতো ভয়াবহ একটা পরিবেশ সে দেখছে!

এরপর তিনি নতুন এক আন্দোলনে পড়েন। ঘোষণা দিয়েই বলেন, আমি যতদিন বেঁচে থাকবো একটি শিশুকেও জেলের দেয়ালের ভেতর বড় হতে দেব না।

পুষ্প জেলে থাকা শিশুদের পড়াশোনার ভার নিজ কাঁধে নেন। এটা ২০০৫ সালের ঘটনা। তিনি শিশুদের জন্য একটি ঘর ভাড়া করে ছয় বছরের নিচে যত শিশু আছে সবাইকে নিয়ে আসেন নিজের ছত্র ছায়ায়।

এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি অত্যন্ত ভালো পরিবেশে পড়াশোনা করে বড় হয়েছি। তাহলে অন্যরা কেনো আমার মতো করে বেড়ে ওঠার অধিকার পাবে না! আমি শিক্ষাকে সবার জন্য মুক্ত করে দেব।

যখন এমন একটি সিদ্ধান্ত পুষ্প নিয়ে ফেলেছেন তখন তার বয়স মাত্র ২১ বছর। পড়াশোনার পাশাপাশি তখন তিনি বিভিন্ন জেলে জেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয়; বিভিন্ন মদের দোকানগুলো থেকেও শিশুদের নিয়ে আসা শুরু করেন।

পুষ্প যখন শিশুদের জন্য ঘর সাজাতে শুরু করেন ঠিক তখনই শুরু হয় বিপত্তি। পরিবার থেকে বাধা দেওয়া শুরু হয়। পরিবারের সবাই বলেন, তোমার উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু এটিকে চালিয়ে নেওয়ার মত অর্থ তোমার কাছে নেই। আর্থিক স্বচ্ছলতা ছাড়া তুমি এ উদ্যোগটিকে এগিয়ে নিতে পারবে না।

পুষ্প এ সম্পর্কে বলেন, আমাকে তখন কেউ বিশ্বাস করতে চায়নি। সবাই হাসাহাসি শুরু করে। অনেকে তো আমাকে পাগলও বলতে শুরু করে।

পরিবারের বাধার মুখেও পুষ্প কোনোভাবে থেমে যাননি। তিনি তার বন্ধুদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা শুরু করেন। সবার থেকে টাকা তুলে একটি বাসা ভাড়া নেন। তারপর মাকে বুঝিয়ে একটি ফ্রিজ ও রান্নাবান্নার আসবাবপত্র কিনে ফেলেন।

শুরু করে দেন শিশুদের জন্য কাজ। শুরুতে সরকারের অনুমতি নিয়ে সকালে শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসতেন। দিনশেষে বিকেলে দিয়ে আসতেন জেলে। কিন্তু পুষ্প এমনটা চান না। জেলে যেন আর শিশুদের যেতেই না হয়; সে চেষ্টায় তিনি লেগেই থাকেন।

এমনকি সরকারের লোকজনই নড়ে চড়ে বসেন। দেশজুড়ে আলোচিত হতে থাকে পুষ্পর এ উদ্যোগ। সরকার অবশেষে পুষ্পকে সহযোগিতা করতে শুরু করে। তারাই পুষ্পকে খবর দেয়, কোন জেলে শিশুদের সংখ্যা বেশি।

২০০৮ সালের দিকে তিনি এর নাম দেন ‘বাটারফ্লাই হোম’। এটা যেন পুষ্পর স্বপ্ন। তিনি বলেন, আমার জীবনটা অসাধারণ। কখনও এক মুহূর্তের জন্য ক্লান্ত হইনি। প্রতিদিন সকালের ব্যস্ততা আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। এমন জীবনের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

পুষ্প বাসনেতের উদ্যোগ এখন অনেক বড়। বহু লোক এখন বাটারফ্লাই হোমে চাকরি করেন। অনেক শিশু তার এখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে হাই স্কুল, কলেজে চলে যাচ্ছে।

জেলে থেকে অসংখ্য আসামীর সন্তানদের অন্ধকার জগৎ থেকে বের করে আনছেন এ তরুণী। তার সম্পর্কে এক আসামী মন্তব্য করে বলেছিল, এ কারাগারের দেয়ালে পচে যেত আমার সন্তান। সে পচন থেকে রক্ষা করলো পুষ্প। এবার আমি শান্তিতে মরতে পারি।

পুষ্প সম্পর্কে ১৪ বছরের এক মেয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বলে, হয়ত আমি অন্ধকারেই থাকতাম। পুষ্প ছাড়া আলোর দেখা পাওয়া সম্ভব ছিল না।

পুষ্প খুব শান্ত স্বভাবের। ধীর স্থির। তিনি বলেন, জীবনের কাছে চাওয়া নেই। যতদিন বেঁচে থাকবো ওদের জন্যই থাকবো। এখন আমার স্বপ্ন একটাই। প্রতিটি শিশুর স্বপ্ন যেন পুরণ হয়।

ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পুষ্প বলেন, আমি কারাগারের দেয়াল ভেঙে দিতে চাই। সেখানে যেন কোনো নিষ্পাপ শিশু থাকতে পারে। সে দেয়াল ভেঙে সব শিশুকে দেখাতে চাই সুন্দর এক পৃথিবী।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।