ইটনা (কিশোরগঞ্জ) থেকে ফিরে : “অষ্টগ্রাম থেকে ‘কুড়া (পানকৌড়ি) শিকার’ (পোষা পানকৌড়ি দিয়ে বুনো পানকৌড়ি শিকার)করতে হারালিয়া গ্রামে এসেছিলো বিনোদ। এই হারালিয়া গ্রামে সে প্রথম দেখে মলুয়া সুন্দরীকে।
ধনু নদীর ওপর চলন্ত ট্রলারে বসে কথাগুলো বলছিলেন ইটনা মহাবিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যক্ষ চৌধুরী কামরুল হাসান। কথায় কথায় জানালেন ‘কুড়া শিকার’ এখনও টিকে আছে। তবে খুব কম লোকই করে।
প্রত্যন্ত হাওর এলাকা কিশোরগঞ্জের ইটনা। ইটনা সদর, ধনপুর, জয়সিদ্ধি, বাদলা, রায়টুটি, এলঙজুরি, বরিবাড়ী, চৌগাঙ্গা আর মৃগা এই নয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ইটনা উপজেলা। বলদা হাওর, শাপলা হাওর, আলালের হাওর, চিন্নির হাওর, তলার হাওর, আঙ্গন হাওর ঘিরে আছে ইটনাকে। হাওর এলাকার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যেই ‘এক ফসলি ধান চাষ’ আর মাছের ওপর চলে এলাকার মানুষের জীবন নির্বাহ।
শীত মৌসুম বলে সবাই ব্যস্ত। তীব্র শৈত্য প্রবাহ উপেক্ষা করেই গ্রামের মানুষ চলে যায় জেগে ওঠা ‘টেকে’ (চর)। সেখানেই চলে চাষাবাদের কাজ। আর মাছ ধরাতো আছেই। তবে চাইলেই যে কেউ মাছ ধরতে পারে না। ব্যক্তিগত ফিসারিজ এবং সরকারি লিজ নেওয়া জায়গায়তেই মূলত মাছ ধরেন মৎসজীবীরা।
ব্যক্তি মালিকানার ফিসারিজে কাজ করেন কবীর হোসেন। তিনি জানালেন, মধ্য জানুয়ারি থেকে মাছ ধরার মূল কাজ শুরু হয়। এছাড়া অন্য সময় অল্প-বিস্তর মাছ পাওয়া যায়। বেড় জাল, কাইট্টা জাল, ভীম জাল, খোনা বেড় এমন নামের জালগুলো দিয়েই চলে মাছ ধরা।

ফরিদ আলী জানালেন, ইটনার এই মাছ পেটি (বক্স) ভরে চলে যায় ভৈরবে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বাইরে।
ফরিদ আলীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই চোখ পড়লো একটু দূরে হাত ছিপ নিয়ে বসে থাকা ষাটোর্ধ্ব রহিমা খাতুনের দিকে। তখন বাজে বেলা বারোটা। দেখা নেই সূর্যের। চারিদিকে কুয়াশা। এই শীতের মধ্যে পানিতে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ডুবিয়ে বেজার মুখে বসে রয়েছেন।
কতগুলো মাছ ধরতে পেরেছেন জানতে চাইলে যেন একটু বিরক্তই হলেন। বললেন, “বইয়াই রইছি মাছ আর পাই না। ” পরের প্রশ্ন করার আগেই ছিপ গুটিয়ে আরেকটু দূরে যাওয়ার শুরু করলেন।
দীর্ঘ ১৩ বছর ট্রলারে মাঝির কাজ করেন জিল্লুর রহমান। মাছ ধরার কাজ করেছেন অনেক দিন। বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নামে নিজের নাম এটাও স্মরণ করিয়ে দিলেন। গর্বে চোখটা একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
তিনি আক্ষেপ করে বললেন, “অহন আর মাছ পাওয়া যায় না। ভেদী (মেনীমাছ), খইলস্যা, রানী দেহি নাই অনেকদিন। শিং ও আর দেহা যায় না। কৈ মাছ কইমা গ্যাছে। ”

মাছ নিয়ে একই আক্ষেপ শুনতে পাই জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদের কণ্ঠেও। তিনি আটবার এই এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। বললেন, “ছোটবেলায় যত মাছ দেখছি এখন আর সেগুলো দেখা যায় না। কারেন্ট জাল আর কীটনাশকের অতিমাত্রায় ব্যবহার এর জন্য দায়ী। ”
চৌধুরী কামরুল হাসান জানালেন, হাওর এলাকায় নভেম্বর থেকে কাজ শুরু হয়। সর্বোচ্চ এপ্রিল পর্যন্ত মানুষের হাতে কাজ থাকে। ধান চাষ আর মাছ জীবিকা নির্বাহের প্রথান উপায় হলেও এখন কিছু কিছু মানুষ সবজি চাষ করছে। ভালো দাম পায় বলে অল্প জামিতে সবজি চাষ শুরু হয়েছে। এছাড়া ‘টেকে’ সরিষা, কলাই আর অল্প পরিমান পেঁয়াজ-রসুনের চাষও শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১২
এসএইচ/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর