ঢাকা: মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবন। প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো অস্থিতিশীল নয় সাব-সাহারা অঞ্চলে মানব সূচক উন্নয়নে শীর্ষ স্থানে থাকা দেশটি।
দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর বোনগোর আমলে গড়ে তোলা হয় ন্যাশনাল পার্ক। গ্যাবনের মোট আয়তনের ১১ শতাংশ এলাকাজুড়ে ওই পার্ক। ‘বন প্রজাতন্ত্র’ নামেও পরিচিত গ্যাবন। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপালিকের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাতারে নেই দেশটি। দাঙ্গা, সহিংসতা বিদ্রোহে থেকে মুক্ত দেশটি।
পেট্রোলিয়ামের সমৃদ্ধ গ্যাবন। ১৯৬০ সালের ১৭ আগস্ট ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ পর্যন্ত তিন জন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে গ্যাবনের জনগণ। ১৯৯০’র দশকে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করে এবং নতুন সংবিধান গ্রহণ করে গ্যাবন। মধ্য আফ্রিকার সমৃদ্ধ দেশগুলোর অন্যতম গ্যাবন।
গ্যাবনে পৃথিবীর দুর্লভ বুনো হাতির নিবাস। তবে এই হাতির স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার সমতল ভূমির হাতির চেয়ে গ্যাবনের হাতিগুলো আকারে ছোট এবং মনোমুগ্ধকর গোলাপী দাঁতের অধিকারী। গাঢ় গোলাপী এসব দাঁত অত্যন্ত মূল্যবান।

তেল খাত থেকে আয় ও মাইলের পর মাইল জুড়ে বনভূমি গ্যাবনের সরকারকে উদ্যমী করেছে বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে। বন্যপ্রাণী রক্ষায় আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম নীতি গ্যাবনের রয়েছে।
বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ একেবারেই বরদাস্ত করা হবে না (জিরো টলারেন্স)—এই নীতি মেনে চলে গ্যাবন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ২৫০ সদস্যের একটি সামরিক শাখা গড়েছে সরকার।
কিন্তু কঠোর নীতি থাকার পরও দেশটির হারাচ্ছে দুর্লভ বুনো হাতিকে। হাতের দাঁতের লোভনীয় দাম ও দেশটির দরিদ্র জরগোষ্ঠীর স্বচ্ছর জীবনের আকাঙ্ক্ষা হাতি নির্মূলে ভূমিকা রাখছে। গরিব জনগণকে ‘মোটা অঙ্কের’ অর্থের বিনিময়ে হাতি হত্যায় প্রলুব্ধ করে পাচারকারীরা।
গ্যাবনে গত কয়েক বছরে ১০ হাজারের মতো হাতি মেরে ফেলা হয়েছে। হাতি নিধনের বড় অংশ হয়েছে অপরাধী চক্রের হাতে। বাদবাকি মারা গেছে জঙ্গলে চুপিসারে ঘুরে বেড়ানো শিকারিদের বন্দুকে এবং অর্থের বিনিময়ে হাতি হত্যাকারী দরিদ্রদের হাতে।
গ্যাবনের জেলগুলো হাতির দাঁত পাচারকারী-চোরাকারবারীতে পরিপূর্ণ। অনেকে চোরাকারবারীদের খপ্পরে পড়ে হাতির দাঁত বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। এমনই একজন মেদজা। চুল-ছাঁটাই বা নাপিতের পেশা তার।
গ্রেফতারের পর কারাগারে তিনি বলেন, “আমার কোনো ধারণা ছিল না যে এগুলো অবৈধ। ” কয়েক মাস আগে হাতির হাত বিক্রির সময় থাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি বলেন, “আমাকে বলা হয়েছিলে দাঁতগুলো বনে পাওয়া গেছে। ”
এশিয়ায় দাঁতের সীমাহীন চাহিদার কারণে গ্যাবনের হাতির সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমছে। জানা গেছে, এশিয়ায় হাতির প্রতি পাউন্ড দাঁতের দাম প্রতি কিলোগ্রাম দুই হাজার ২০০ মার্কিন ডলার।
এই উচ্চমূল্য অনেককে প্রলুব্ধ করছে হাতি নিধনে। আফ্রিকা মহাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার হাতি নিধন করা হচ্ছে। কয়েক দশক আগে মধ্য আফ্রিকার জঙ্গলগুলোতে সাত লাখের মতো হাতি ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু আজ সেই সংখ্যা মাত্র ১০ হাজার। এই ১০ হাজারের অর্ধেক গ্যাবনে।

দাঁতের ব্যবসা বন্ধের জন্য গত জুনে গ্যাবনের প্রেসিডেন্ট আলি বোনগো প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোগ্রাম দাঁত জ্বালিয়ে ছাই করেন। তিন দিন লাগে দাঁতগুলো পুড়তে। শেষ দাঁতটি পুড়ে ছাই হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী প্রহরারত ছিল।
আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মতে, হাতির দাঁতের অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়ারা। তারা স্থানীয় কর্মকর্তাদের ভাড়া করে এবং তাদের সহায়তায় গোপনে আফ্রিকার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে বেইজিং, ব্যাংকক ও ম্যানিলায় হাতির দাঁত পাচার করে।
কানের দুল, নকল দাঁত, ফ্যান, পিয়ানো কিসহ চিত্রকর্ম, মূল্যবান ধর্মীয় বস্তু, সাদা ভাস্কর্য ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় হাতির দাঁত।
মাফিয়ার প্রথমে বনের আশপাশের কোনো দরিদ্র ব্যক্তির সঙ্গে লিয়াজো করে। দরিদ্র ব্যক্তিদের অর্থের বিনিময়ে হাতি হত্যায় প্রলুব্ধ করে। বিতোগার বনে বেড়ে ওঠা তরুণ ম্যানিক ইমেন হাতি হত্যা করতে সম্মত হয় সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে। ইমেনের সরল স্বীকারোক্তি, “ন্যায্য দামে আমি হাতি হত্যা করব। ”
তিনি বলেন, “জীবন খুবই কঠিন। তাই যদি কেউ আমাদের বড় অংকের টাকা দেয়, আমরা এটি করব। ” মাত্র ৫০ ডলারই ইমেনের কাছে অনেক অর্থ।
ইমেনের বন্ধু ভিনসেন্ট বিয়োগোও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, “জন্মের পর আমি উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতাম। গাড়ি চালানো, স্কুলে যাওয়া ও একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখতাম। ”
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওয়েমের কারাগারগুলো বাকা সম্প্রদায়ের শিকারিদের দিয়ে ভরা। নামমাত্র অর্থে তারা হাতি হত্যায় সহযোগিতা করেছিল। বাকা শিকারিরা জানিয়েছে, তাদের প্রায় ভালো পোশাক পরিহিত বন্দুকধারীরা হাতি নিধনের প্রস্তাব দিত।
বিদেশি পত্রিকা ও ওয়েবসাইট অবলম্বনে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের ফিচার
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৩
আরআর