ঢাকা: শুক্রবার ও ছুটির দিনে মানুষের হাট বসে হাতিরঝিল- বেগুনবাড়ি এলাকায়। বিকেলের পর এখানে হাজার হাজার মানুষ আসে।
রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা, জলাবদ্ধতা নিরসন, স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নতুন সড়কে তৈরির লক্ষ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও ছুটির দিনগুলোতে প্রকল্প এলাকা পরিণত হয় বিনোদনকেন্দ্র ও জনসমুদ্রে।
পায়ে হেঁটে, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, কার, মাইক্রোবাস এমনকি ঘোড়ার গাড়িতে করেও মানুষ আসে। তাই রাস্তার দু’ধারে ও ব্রিজে মানুষের মেলা বসে যায়। প্রকল্পের নয়নাভিরাম লেক, সেতু ও বাহারি রঙের ফুলের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখে নগরবাসী রীতিমতো মুগ্ধ।
শুক্রবার সরজমিনে দেখা গেছে, গাড়ির চাপে মগবাজার সংলগ্ন রাস্তার মুখ, ইস্কাটনের নিকর্টবর্তী ব্রিজ, গুলশানের পাশের ব্রিজে গাড়িগুলো যানজটে পড়ছে। নিয়ম অমান্য করে অনেকে বসেন ব্রিজের রেলিংয়ের ওপর। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া পার্কিং নিষেধ থাকলেও যেখানে-সেখানে পার্কিং করা হয়েছে। এছাড়াও ওভারপাসে গাড়ি পার্কিং করায় তীব্র যানজট লেগে যায়।
সেনাসদস্য ও দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছুটির দিনগুলোতে সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের আগমন শুরু হয়। তবে দুপুরের পর মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে আসেন দর্শনার্থীরা। বিকেলে বিভিন্ন বয়সের দর্শনার্থীর ভিড়ে প্রকল্প এলাকা উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে হাতিরঝিল রুপ নেয় জনসমুদ্রে। ক্যামেরা মোবাইলে ছবি তুলে স্মৃতি ধরে রাখতে ব্যস্ত থাকেন অনেক মানুষ।
উদ্বোধনের পর থেকেই হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় জমাচ্ছেন হাতিরঝিল এলাকায়। উদ্বোধনের পর থেকেই প্রতি শুক্রবার ও ছুটির দিনে প্রকল্প এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। গত ২ জানুয়ারি রাজধানীর আলোচিত হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী খাল সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরই প্রকল্পভুক্ত এলাকা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
তবে বেশি মানুষ আসায় প্রকল্প এলাকাটিতে খাবারের প্যাকেট ও ক্যানের কারনে নোংরা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় কর্তব্যরত সেনাসদস্য ও পুলিশ সদস্যরা খাবারের খালি মোড়ক বা বোতল মতো আবর্জনা লেকের পানিসহ যেখানে-সেখানে ফেলতে নিষেধ করেন। ভ্রাম্যমাণ দোকানাদার ও হকারদের ধরে এলাকার বাইরে পাঠাতেও দেখা গেছে।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ঝলমল করে জ্বলে ওঠে লাল-নীল আলো। শুধু ব্রিজে নয়, পুরো হাতিরঝিল রাতে নানা রঙের আলোয় মনোরম হয়ে ওঠে। প্রকল্পের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে আলোর প্রতিফলনে খোলা আকাশের নিচে তৈরি হয় এক মনোরম পরিবেশের।
বাসাবোর রহমত হোসেন পেশায় একজন ব্যবসায়ী। হাতিরঝিলে বেড়াতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসার শত ব্যস্ততায় পরিবার নিয়ে ঘোরা হয় না। আবার ঢাকার সব জায়গায় গাড়ি নিয়ে যাওয়া সহজ নয়। আমি আমার পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। ইউরোপীয় শহর মনে হচ্ছে এখানে এসে। ’’
উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী বেড়াতে এসেছেন। তারা জানান, এখানে পরিবেশ ভালো। সব আয়োজন অনেক সুন্দর হয়েছে। তবে রাইডার, নৌকাসহ আরও গাড়ি সার্ভস থাকলে ভালো হতো।
নয়নাভিরাম এই প্রকল্পে রয়েছে ফুটপাত ছাড়াও নির্বিঘ্নে হেঁটে চলার জন্য প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ। তেজগাঁও দক্ষিণ কুনিপাড়ার সামনে ব্রিজের সংযোগ সড়ক এবং টঙ্গী ডাইভারশন রোড-প্রগতি সরণি সংযোগ সড়কের পাশে একটি কার ও সাইকেল পার্কিং আর গুলশান অংশে একটি কার পার্কিং নির্মাণ করা হয়েছে। ঝিলে সব স্যুয়ারেজ কানেকশন বন্ধ করা হয়েছে। রাস্তার পাশে লাগানো হয়েছে সারিবদ্ধ বিভিন্ন দেশীয় ফুলের গাছ। রয়েছে খেজুর আর তালগাছের সারি।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া ‘হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি খাল সমন্বিত উন্নয়ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এলজিইডি বিভাগ ও ঢাকা ওয়াসা। আর পরামর্শক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটি সম্পাদনের মূল দায়িত্বে ছিল রাজউক ও এলজিইডি বিভাগ। কিন্তু প্রকল্প সম্পন্ন করতে গিয়ে ৭৬টি মামলা মোকাবেলা করতে হয়েছে রাজউককে, যার ৭০টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স ১৬ ইসিবিকে সম্পূর্ণভাবে প্রকল্প সম্পাদনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে তাদের সহায়তা করছে রাজউক, এলজিইডি ও ওয়াসা।
চালু হলেও প্রকল্পটি রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাজউক, ঢাকা ওয়াসা ও এলজিইডি বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো একটিকে অথবা `হাতিরঝিল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ` নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করে হাতিরঝিল প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের চিন্তা-ভাবনা চলছে।
রাজধানীর বাংলামোটর থেকে মগবাজার-টঙ্গী ডাইভারশন রোড পেরিয়ে একদিকে রামপুরা ও অন্যদিকে গুলশান-বাড্ডা এলাকা পর্যন্ত হাতিরঝিল প্রকল্প বিস্তৃত।
ছুটির দিনগুলোতে প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে। ঝিলের সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে এর নয়নাভিরাম সেতুগুলো। রাতের বেলা এর আলোর ঝলকানিতে এক অন্যরকম দ্যেতনার সৃষ্টি করে। নগরীর সৌন্দর্য্য-পিপাসুদের কাছে এটিই এখন বড় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তবে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ জরুরি বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৩
এমআইআর/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- eic@banglanews24.com