কবছর আগে হুট করেই গুগল ছেড়ে ফেসবুকে প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন শার্লি স্যান্ডবার্গ । এখন ফেসবুকের সেলস, মার্কেটিং, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স, পাবলিক পলিসি এবং কমিউনিকেশন নিয়ে কাজ করছেন শার্লি।
শার্লি স্যান্ডবার্গ গুগলের অনলাইন বিক্রি পদ্ধতির জনক। তার সময়েই গুগল নানা ব্যবসায়ী চিন্তায় মগ্ন হয়। তবে তারও আগে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চিফ স্টাফ পদে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন স্যান্ডবার্গ। জুকারবার্গ তার সম্পর্কে একবার বলেছিল, ফেসবুকের একজন অভিভাবক প্রয়োজন। যে কি না প্রতিষ্ঠানের চেহারা বদলে দিতে পারবে। স্যান্ডবার্গ ছিল আমাদের সঠিক পছন্দ।
স্যান্ডবার্গ ২০১২ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের প্রভাবশালী নারীদের অন্যতম হিসেবে নির্বাচিত হন। নারী নেতৃত্বকে এগিয়ে দেওয়া এ মানুষটি ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর টেডএক্স সম্মেলনে অসাধারণ এক বক্তৃতা দেন।
বাংলানিজের পাঠকদের জন্য এ বক্তৃতার বিভিন্ন গৃরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো।
আমরা সবাই ভাগ্যবান। এটা দিয়েই শুরু করি। দারুণ এক সুন্দর বিশ্বে আমাদের বসবাস। এমন বিশ্ব আমাদের বাবা-মা কিংবা নানী-দাদীরাও পায়নি। সে সময় নারীদের জন্য সব সুযোগ ছিল সীমিত। আজকে এখানে যারা উপস্থিত আছেন তাদের সবাই অধিকারের স্বাদ গ্রহণ করেই বড় হতে পেরেছি।
যদিও এখনও অনেকে সাধারণ অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সব কিছু মিলিয়ে এখন অনেক সমস্যার ভেতর দিয়েই যেতে হচ্ছে। এটি একটি সমস্যা। আর সমস্যাটি হলো, নারীরা প্রফেশনের জায়গায় এখনও নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
সংখ্যাই বলে দেয় নেতৃত্বের অভাব। এ এস্টেটের ১৯০ জন প্রধানের মধ্যে মাত্র ৯ জন নারী নেত্রী। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সব সংসদ সদস্যদের হিসাবে দেখা যায় মাত্র ১৩ ভাগ নারী সংসদ সদস্য। করপোরেট খাতে নারীর সংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ ভাগ। এ হিসাব ২০০২ সালের পর খুব একটা বাড়েনি। বরং কমেছে।
এটি কেন? এ উত্তর আমার কাছে নেই। আমার নিজের জন্যও কোনো উত্তর নেই। আজকের এ আয়োজনে আসার জন্য সানফ্রান্সিসকো হয়ে আসতে হয়েছে। যখন প্লেনে উঠবো তখন আমার তিন বছরের মেয়ের জন্য খারাপ লাগছিল। তারও লেগেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, মা যেও না।
আমার তখন প্রচণ্ড অপরাধবোধ হচ্ছিল। নারীদের বিষয়গুলো এমনই। কাজে কিংবা ঘরে থাকুক না কেন, তারা প্রায়ই এমন মনোকষ্টে ভোগে। তাই আমি এটাও বলতে চাই না যে, শুধু অফিসের কাজ করাই একজন নারীর প্রধান কাজ।
আজকের বক্তৃতার বার্তা সেসব নারীদের জন্য যারা কাজের সঙ্গে থাকতে চায়। এ জন্য তিন ধরনের বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে। প্রথমত হলো, সব সময় সামনের সারিতে থাকো। দ্বিতীয়ত তোমার সঙ্গীকে সত্যিকারের সঙ্গী করে গড়ে তোলো। তৃতীয়ত ছেড়ে দেওয়ার আগেই ছেড়ে যেও না।
প্রথমটির ব্যাখ্যা দিই। কয়েকসপ্তাহ আগে ফেসবুকে এক সেমিনারে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা এসেছিলেন। মিটিং রুমে সবাই একসঙ্গেই বসলাম। সে কর্মকর্তার সঙ্গে দুজন নারীও আসলেন। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা যথেষ্ঠ অভিজ্ঞ। আর উক্ত মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে চাকরি করেন।
যখন মিটিং শুরু হলো তখন দুজনকে আমাদের সঙ্গেই বসার আমন্ত্রণ জানালাম। কিন্তু তারা আসতে চাইলো না। তারা অন্যরুমে গিয়ে বসলেন। এ হলো পিছিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপ। সামনের সারিতে নারীদের যেতে অপারগতার কারণেই তারা পিছিয়ে যাচ্ছে।
এবার সামনে এগিয়ে আসার গল্প বলি। একবার ফেসবুকে সব স্টাফদের সঙ্গে বৈঠক চলছে। অনেক্ষণ ধরেই খেয়াল করছিলাম বয়সে খুব কম একটি মেয়ে হাত তুলে দাঁড়িয়েই আছে। আমি তার দিকে তাকাতেই সে বলল, আমার কিছু বলার আছে।
মেয়েটি একটু দুরে ছিল। তাকে কাছে এনে বসালাম। তারপর তার প্রশ্ন জানতে চাইলাম। সে বলল, আজকে এখানে কিছু বিষয় শিখলাম। আমি শিখলাম, আমার হাত সব সময় উঠিয়েই রাখতে হবে।
আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, এর মানে কি?
সে আবার বলল, আপনি অনেকক্ষণ ধরেই বক্তৃতা দিচ্ছেন। তারপর বললেন, দুটি প্রশ্ন নেবেন। আমিও হাত তুললাম অন্যদের মত।
আপনি দুটি প্রশ্ন নিলেন। উত্তরও দিলেন। তখন হাত নামিয়ে ফেললাম। খেয়াল করলাম অন্য সব মেয়েরাও হাত নামিয়ে ফেলল। আপনি আবার প্রশ্ন নিলেন। তবে প্রতিবারই ছেলেদের কাছ থেকেই প্রশ্ন নিচ্ছেন।
মেয়েটির কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। কারণ প্রশ্ন নেওয়ার সময় মনেই হয়নি কে পুরুষ, কে নারী। আমি শুধু প্রশ্ন নিয়েছি। তখন মনে হলো, তার মানে পুরুষেরা নিজের সুযোগ তৈরি করে নিতে প্রচন্ড উদ্যোগী। তারপরও ভালো লাগছিল। কারণ অন্তত একজন নারীকে প্রতিবাদ করে সামনের সারিতে চলে আসতে দেখছি।
দ্বিতীয় পয়েন্টে আসি। তোমার সঙ্গীতে সত্যিকারের সঙ্গী হিসেবে গড়ে তোলো। এ মুহূর্তে নারীরা কাজের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা একই সঙ্গে ঘর ও অফিস সামলাতে পারদর্শী হয়ে উঠছে। যেখানে পিছিয়ে আছে পুরুষেরা। তাদের যদি ঘরের কাজ সামলাতে বলা হয়, তখন তারা হিমশিম খায়। অথচ অফিসের কাজ ও ঘরের একসঙ্গে দুটি চাকরি করার ক্ষমতা একমাত্র নারীদেরই আছে।

আমার মনে হয় এ সমাজই পুরুষকে চাপের মুখে রাখে। তাদের সব সময় সফল হতে বলা হয়। সে ক্ষেত্রে মেয়েদের খুব একটা চাপ নেই। একজন ছেলে ঘরের কাজ করবে এবং ঘর সামাল দেওয়াকেই পেশা হিসেবে বেছে নেবে। এ সমাজের জন্য এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিবারে দুজন মানুষের সমান আয়, সমান দায়িত্ব ভাগ করে নিলে ডিভোর্সের হার নেমে পড়ে অর্ধেকে। সেখানে পরিবারের যদি একজনের রাজত্ব থাকে, তবে ডিভোর্সের হার বেড়ে যায়।
তৃতীয় পয়েন্ট হলো- ছেড়ে যাওয়ার আগেই ছেড়ে যেও না। এটি খুব গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। আমরা সবাই ব্যস্ত। মেয়েরাও ব্যস্ত। একজন মেয়ের জীবনে কত সংগ্রাম করতে হয়। কত কি ভাবতে হয়। যখনই কারো বিয়ে হয়ে যায়, তাকে বাচ্চা নিয়ে ভাবতে হয়। যখন তার সন্তান পৃথিবীতে আসে তখন তার জগৎটা হয়ে পড়ে এককেন্দ্রিক। এমন একটি সময়ে সে কেন অফিসের কাজে মাথা ঘামাবে? কেন সে যেচে গিয়ে সামনের সারিতে আসবে? কেন সে নতুন প্রজেক্ট নিয়ে নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করবে? কারণ জগৎ জুড়ে তো তার সন্তান! সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবনা। সে ভাবনায় নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?
কোনো মেয়ে সেসময় বলে না, আমি নতুন কিছু করতে চাই। নিজেকে প্রমাণ করে অফিসের সবচেয়ে উচ্চপদে যেতে চাই। কেউ বলে না। ঠিক তখনই আমরা পিছিয়ে পড়ি।
যখন কোনো মেয়ের প্রেম হয়, ঠিক তখন থেকেই সে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। অনেকের ক্ষেত্রে বিয়ের আগেই সন্তানদের নিয়ে ভাবে। এ ভাবনাটি মোটেও অন্যায় নয়। অবশ্যই ভাবতে হবে। একটি সন্তান যেকোনো মানুষের জীবনে পরম পাওয়া।
আমি শুধু বলতে চাই, যখন কেউ মা হবেন, তখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রয়োজন নেই। সময় নিন। সন্তানকে সময় দিন। যেভাবে অফিসে সময় যাচ্ছে সেভাবে যেতে থাকুক। হয়ত সে সময়ের মধ্যে আপনার প্রোমোশন হবে না। হয়ত আটকেও যাবে।
ক্লান্ত হয়ে পড়বেন আপনি। তাও সাইকেলের পেডেলে পা চালাতে থাকুন। হয়ত অফিস আপনার কাজে খুশী হবে না। এ জন্য আপনি হতাশাতেও ভুগতে পারেন। কিন্তু অফিস যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে না পৌছায় ততক্ষণ পর্যন্ত এগিয়ে যান ধীরে ধীরে। সময়টা হয়ত ৩ কিংবা ৫ বছরও হতে পারে।
কিন্তু আপনার সন্তানটি যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকবে দেখবেন আপনি কাজের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে সময় বের করতে পারবেন। তখন চ্যালেঞ্জ নিন। মেয়েরা পারে না এমন কিছুই নেই। আপনি তখন চাইলেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। সে যোগ্যতা পৃথিবীর সব মেয়েদের আছে। এ জন্যই বলেছি, ছেড়ে যাওয়ার আগেই ছেড়ে যাবেন না।
তবে দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের প্রজন্মের মেয়েরা খুব বেশি এগুতে পারেনি। বলা হয়, বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। কিন্তু বিশ্বের সব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মধ্যে অর্ধেক নারী নেতৃত্ব নেই। নারী নেতৃত্ব প্রয়োজন। তারপরও আমি স্বপ্ন দেখি তরুণ প্রজন্ম এ শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে। তাদের সে যোগ্যতা আছে। তারা যেভাবে নিজেদের গড়ে তুলছে একদিন এ প্রজন্মের মেয়েরাই বিশ্বজয় করে ফেলবে। শুধু একটি কথা মনে রাখবেন, যে মা ঘরকে সামলাতে পারেন, তিনিই প্রধান নেতা। সে নেতা নিজের কাজের জায়গাতেও সেরা হতে পারবেন। এজন্য আত্মবিশ্বাস জরুরি।
নারীরাই এ বিশ্বকে শান্তিময় করে তুলতে পারবে। আমার দুটি সন্তান আছে। পাঁচ বছরের ছেলে এবং দুই বছরের মেয়ে। আমি চাই আমার ছেলে ঘর ও বাহির দুজায়গাতেই নিজেকে প্রমাণ করবে। ঠিক একইভাবে আমার মেয়ের বেলাতেও এমনটাই চাই। সামনে আসতে হলে নেতৃত্ব মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। এটা পরিবার থেকেই শুরু হোক।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ আল সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক/ সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর