ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

খাজা বাবার আজমীর শরীফ

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০২, জানুয়ারি ২৩, ২০১৩
খাজা বাবার আজমীর শরীফ

‘আজমীর শরীফ’ দেখতে মন ব্যাকুল হলো জয়পুরে পৌঁছেই। রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালেই প্রস্তুতি নিলাম খাজা বাবার শরীফে গিয়ে যদি একটুকু দোয়া মেলে তবেই তো জীবনটা হবে সার্থক।



এ কথা ভাবতে ভাবতে জয়পুর থেকে উঠলাম আজমীরের বাসে। শহর ছাড়িয়ে এগিয়ে চলছে বাস। যে দিকে চোখ যায় মনে হয়, এ যেনো মরু অঞ্চল। দূরে ওই যে খেজুর গাছ- কেউবা উট নিয়ে যাচ্ছে।

কেউবা উঠের পিঠে। তখনতো প্রচন্ড গরম। ছিল মে মাস। মনে হয়, প্রচন্ড তাপে যেনো দগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। যতোই গরমে অস্থির হই না কেন- তবুও মনে বড় আশা, কখন গিয়ে যে পৌঁছবো আজমীর শরীফে।

সকাল ৭টায় ছেড়ে যাওয়া বাস ৪ ঘণ্টা পরে ১১টায় গিয়ে পৌঁছলো আজমীর শরীফে। যে দিকে তাকাই মনে হয়- এ যেনো এক পবিত্র ভূমি। কত না মানুষের মনে স্বপ্ন জাগে, আজমীর শরীফে আসার।

কারো স্বপ্ন পূরণ হয়, কারো বা পূরণ হয় না! বাহ তবুতো এসেছি। ভাবছি আর ভাবছি- কোথায় আমার বাংলাদেশ আর কতই না দূরে এই আজমীর শরীফ!

সড়কপথে ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছতে ১৩ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। কলকাতার হাওড়া থেকে যোধপুর এক্সপ্রেসে জয়পুরে ৩০ ঘণ্টা আর জয়পুর থেকে আজমীর শরীফে পৌঁছতে ৪ ঘণ্টা। সে হিসেবে আজমীরে পৌঁছতে সর্বমোট ৪৭ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। তা ২ দিন ২ রাতের প্রায় সমান।

আজমীর শরীফে ঢুকেই বারবার মনে পড়লো : ‘খোদার প্রেমে শরাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই পড়ে/ ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে ওই পথ ধরে/ দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ রোজার বদলাতে/ চাই না বেহেস্ত খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত করে ...’ গানের এ কথাগুলো। দু’নয়ন ভরে শুধু দেখে যাচ্ছি। খালি পায়ে এগিয়ে গিয়ে দু’হাত তুলে মোনাজাত : ‘বাবা তোমার দরবারে এসেছি- চাই না কিছুই, দোয়া করো আবারও যেনো আসতে পারি ...’

সঙ্গে ছিল বন্ধু মাহামুদ রানা। ও বললো, চলুন হোটেলে গিয়ে উঠি। একটু এগিয়ে দেখি হোটেলের নাম ‘দিল্লি দরবার’। ওখানে গিয়ে উঠতেই ম্যানেজার বললেন, ভাড়াটাড়া নিয়ে কথা বলবেন নাÑ যা দেবেন তাতেই খুশি হবো।

রানা বললো, একটু বলে কয়ে নিলে কী ভালো হয় না! আমরা তো আর মালদার পার্টি না। খাজা বাবার দরবারে আসবো বলেই এখানে আসা। এসি দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ৮০০ টাকার বেশি দেবো না।

এ কথা শুনে ম্যানেজার একটু হেসে- ঠিক আছে উঠুন তো রুমে। রুমে ঢুকে বাথরুমের কাজ সেরে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে গাইডের উপস্থিতি। তিনি বললেন, বিকেলে আজমীরের আশপাশের এলাকা দেখবেন তো?

বললাম, দেখবো, অবশ্যই দেখবো! এদিকে রানার জিজ্ঞাসা, আচ্ছা আজমীরের ইতিহাসটা একটু বলুনতো! গাইড একটু হেসে- ৭ শতকে রাজা অজয়পাল চৌহান আজমীর নগরীর পত্তন করেন।

১১৯৩ সাল পর্যন্ত এখানে চৌহান বংশের রাজারা রাজ্যপাট চালিয়েছিলেন। রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহান মোহাম্মদ ঘোরির সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হলে চৌহানরা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।

এরপরে এখানে শুরু হয় মুসলিম শাসন। এই আমিতো মুসলিম, আমার নাম সালমান খান ...। কথাটা শুনে রানা বললো বাহ আপনাকে দেখতেও নায়ক সালমান খানের মতো। কথাটা শুনে খুশিতে গাইড মিটিমিটি হাসছিল।

রানা- আজমীর সম্পর্কে আর কী বলবেন? গাইড সালমান- এই আজমীর মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থভূমি। এখানকার মুখ্য দ্রষ্টব্য দরগা শরীফ। এটি সুফি খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির দরগা।

ধর্মের গুরুত্বের বিচারে মক্কা-মদিনার পরেই এই দরগা শরীফের স্থান। জানেন, সেই মোগল আমলে মোগল সম্রাট আকবর আগ্রা থেকে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে এখানে আসতেন। শহরের গলিপথের মধ্য দিয়ে হেঁটেই দরগায় পৌঁছানো যায়।

এখানের প্রবেশদ্বারটি বিশালাকার ও শিল্পম-িত। এটি বানিয়েছিলেন হায়দ্ররাবাদের নিজাম। এদিকে আমাদের ঘুম ঘুম আসছিল। বললাম, সালমান সাহেব আপনি বিকেল পাঁচটায় আসুন।

বিকেলে গাইডের সঙ্গে বের হলাম আজমীর শরীফ দেখতে। গাইড বললো, সন্ধ্যার পরে না হয় যাবেন দরগা শরীফে। তার কথায় সম্মত হয়ে চললাম, আড়াই দিন কা ঝোপড়া দেখতে। এসে দেখি, এটি মসজিদ।

গাইড বললো, এই মসজিদটি আড়াই দিনে নির্মাণ করিয়েছিলেন মোহাম্মদ ঘোরি। যে জন্য এর নাম হয়েছে- আড়াই দিন কা ঝোপড়া। এবার চলুন তারাগড় দুর্গ দেখতে।

পাহাড়ের উপরে উঠতে অসুবিধা হবে ভেবে উপরে না উঠে দূর থেকে তারাগড় দুর্গ দেখে নিলাম। এরপরে আনা সাগর  হ্রদ, ফতেসাগর  হ্রদ দেখে সন্ধ্যার পরপরই এসে পৌঁছলাম খাজা বাবার দরগায়।

দরগায় ঢুকতেই গাইড সালমান খান জানালেন, কিংবদন্তির প্রবাদ পুরুষ খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি ১১৯২ সালে মোহাম্মদ ঘোরির সঙ্গে ভারতে আসেন। কিংবদন্তি, পারস্যের সঞ্জারে ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির।

মক্কা হয়ে মদিনায় যেতে তিনি হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৈববাণী পেয়ে হিন্দুস্থানে আসেন ইসলামের মাহাত্ম প্রচারে। অবস্থানও সেই থেকে আজমীরে খাজা মইনুদ্দিন চিস্তির, ইন্তেকালও হয় আজমীরে, সমাহিত রয়েছেন এখানে। তাঁর মাজার অর্থাৎ সমাধিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ২টি মসজিদ। ওই যে দেখুন ...।

মসজিদ দেখে খাজাবাবার দরগার পাশে এসে দাঁড়ালাম। রাতে নানা রংয়ের বাতিতে ঝলমল করেছিল দরবার শরীফ। এখানে একটি সম্মেলন কক্ষ আর রূপার পাতে মোড়া বুলন্দ দরওয়াজাও দেখলাম। গাইড বললো, রূপার পাতে মোড়া মূল সমাধি সৌধটি।

মাণ্ডুর সুলতান মোহাম্মদ খিলজির হাতে এটি তৈরি শুরু হয় ১২৪৬ সালে। তবে সম্পূর্ণতা পায় মোগল সম্রাট হুমায়ূনের হাতে। এখানের একটি মসজিদ নির্মাণ করান মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর অপরটি তৈরি করান মোগল সম্রাট শাহজাহান।

শ্বেত মর্মরের পুমা মসজিদটিই কিন্তু সম্রাট শাহজাহানের সময়ে গড়ে তোলা হয় এই আজমীর। এবার উপরে তাকালাম। দেখি গম্বুজের চূড়া সোনার পাতে মোড়া। রাতের আলোতে আরও ঝলমল করছিল।

বারবার দেখেও যেনো দেখা শেষ হচ্ছিল না। রানা আমার হাতটি স্পর্শ করে বললো, চলুন হোটেলে ফিরে যাই। বড্ড টায়ার্ড। গাইডের হাতে একশত টাকা দিতেই একটু হেসে- প্রতি বছর রজব মাসের ১ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত উরস পালিত হয়- তখন আসবেন কিন্তু। ওই সময় বিরিয়ানি রান্না হয়- নিমন্ত্রণ রইলো।

ফিরে এলাম হোটেলে। ম্যানেজার বললেন, দেখাটেখা শেষ হলো তো? রানা বললো, আজমীর এসে মনের আশা পূরণ হয়েছে। এবার কিন্তু দিল্লি দরবারে এলাম ...। বুঝতেই তো পারছেন, দিল্লির বিখ্যাত খাবারগুলো খেতে চাচ্ছি। ম্যানেজার একটু হেসে- সে তো দিল্লিতে মিলবে।

রাতে বিরিয়ানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন বেলা ১টার দিকে জয়পুরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। এরআগে পায়ে হেঁটে দেখে নিলাম আজমীর শহরটি। রাজস্থান পর্যটনের হোটেল খাদিম, প্রাইভেট হোটেল- হোটেল সাহিল, হোটেল শংকর ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল শোভরাজ, হোটেল অজয় মেরু, হোটেল রিজেন্সি, হোটেল হাভেলি- প্রভৃতি চোখে পড়লো এবং তা সঙ্গে সঙ্গে নোট বুকে লিখে নিলাম।

এবার চলছি রাজস্থানের রাজধানী পিংক সিটির দিকে। দু’ঘণ্টা পরে ৩টার দিকে ১৫ মিনিটের জন্য বাস রাখলো একটি রেস্টুরেন্টের কাছে। নেমেই পরিচয় হলো বাঙালি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। উনিও এসেছিলেন আজমীর শরীফে। ওখান থেকে পুস্কারে গিয়েছিলেন তিনি।

ভদ্রলোকের নাম অজয় কর। উনি বললেন, পুস্কারে গেলে ভালো লাগতো। যদিও হিন্দুতীর্থ স্থান তবুও পুস্কর দেখায় আনন্দ আছে। কিংবদন্তি, ব্রহ্মার হাত থেকে পদ্মফুল পড়ে সৃষ্টি হয় পুস্করের সরোবর ...। মনে মনে ভাবলাম, এমন জায়গায় গেলেতো অনেক কিছুই জানা হতো।

অজয় কর আরও জানালেন, পুস্করের হ্রদের ধারে রয়েছে ব্রহ্মমন্দির। প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় এখানে ১০ দিন ধরে চলে মেলা ও পুন্যস্নান। পুস্করের দুটি পাহাড়ের মাথায় রয়েছে সাবিত্রী ও গায়ত্রী দেবীর মন্দির।

এছাড়াও  হ্রদের ধারে বাঁধানো ঘাট ও লাগোয়া সাদা রঙের বাড়ি ও মন্দিরগুলো দেখতে সুন্দর লাগে। শীতে হ্রদের জলে দেখা মেলে অসংখ্য পাখি।

বাস ছেড়ে দেবে এখনইÑ এ কথা জানালো চালক। তাই সিটে গিয়ে বসলাম। বাস চলছে জয়পুরের দিকে। বারবার এখন মনে পড়ছিল- এক রাত এক দিনের স্মৃতি ... আজমীর দেখা সে কী এ জীবনে আর হবে! তবুও যে আজমীর শরীফে গিয়েছি- সে কথাতো কোনদিনই ভোলার নয় ...।
 
বাংলাদেশ সময় : ১৬৫২ ঘন্টা, জানুয়ারি ২৩, ২০১২
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।