ঢাকা: দেশের প্রাকৃতিক উৎসসমূহে মাছের প্রাপ্যতা দিন দিন কমছে। অন্যদিকে বাড়ছে চাষাবাদে উৎপাদিত মাছের পরিমাণ।
শনিবার মধ্যরাতে রাজধানীর প্রধান মাছের আড়ৎ পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী সোয়ারিঘাট ও কাওরান বাজার ঘুরে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উৎসের মাছের প্রাপ্যতার ব্যাপক পরিবর্তনের অনেক বিষয় জানা যায়।
দেশের বৃহৎ এই দুই আড়তের মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, গত এক থেকে দেড় যুগের ব্যবধানে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের অর্থাৎ মিঠাপানির মুক্ত জলাশয়-বিল, হাওর, খাল, নদী-নালা ইত্যাদি ও সমুদ্র এবং উপকূলীয় উৎস থেকে মাছের প্রাপ্যতা কমেছে অর্ধেকেরও বেশি।
তারা জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মাছের চাহিদাও আগের তুলনায় কমপক্ষে দশগুণ বেড়েছে। এ বর্ধিত মাছের চাহিদা পূরণে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ দিন দিন কমতে থাকায় সহায়ক হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খামারে উৎপাদিত মাছ। বর্তমানে মাছের সিংহ ভাগ চাহিদাই পূরণ করছে খামারে উৎপাদিত মাছ।
এছাড়া প্রতিবেশি দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানিকৃত মাছও এ চাহিদার খানিকটা পূরণ করছে।
চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের কামাল হোসেন (৩৮) পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শৈশবেই রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমান ১৯৭৭ সালে। আশির দশকে কাওরান বাজার মৎস্য আড়তের গোড়াপত্তনের শুরু থেকেই এখানে মাছ উঠানামার কাজ করতে থাকে।
পরিণত বয়সে (বর্তমানে) কামাল নিজেই একজন আড়তদার। সূর্য এন্টারপ্রাইজের মালিক। দীর্ঘদিনের দেখা মাছের আড়তের নানা বিবর্তন তুলে ধরেন বাংলানিউজের রাতের টিমের কাছে।
কামাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘যহন ছোডকালে এ আড়তে কাম করি, তহন চাষের মাছ বলতে কিছু ছিলো না। সবই ছিলো খালবিল-হাওর আর সমুদ্রের মাছ। আর এহন বেশির ভাগই চাষের মাছ। এ মাছ না থাগলে হয়তো মানুষ মাছই খাইবার পারতো না। ’’
কাওরান বাজার আড়তের মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশির দশকে কাওরান বাজারের মূল অংশে মাছের আড়ৎ থাকলেও নব্বইয়ের দশকে তা সোনারগাঁও লিংক রোডের পূর্ব পান্থপথ অংশের বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এ আড়তের মোট ৫টি মার্কেটে বিভক্ত আড়তদারের সংখ্যা কমপক্ষে সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’।
মার্কেটগুলো হচ্ছে-মা মৎস্য মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা মৎস্য মার্কেট, জনতা মৎস্য মার্কেট, সোনারবাংলা মৎস্য মার্কেট ও ঢাকা প্রগতি মৎস্য মার্কেট।

এসব মার্কেটের মাছের আড়তদাররা জানান, এই শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এ আড়তে মাছ এসে থাকে। এর মধ্যে, মুক্ত জলাশয়ের নানারকমের ছোট প্রজাতির মাছ, সামুদ্রিক মাছ ও চাষের মাছ রয়েছে। রয়েছে বিল-হাওর-বাওড় ও খামারে চাষ করা জিওল মাছও।
আড়তদারদের দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজার থেকে ইলিশ, পোয়া, সাদা চেওয়া, কুরাল, লইট্যা, রিটাসহ কয়েক প্রকারের সামুদ্রিক মাছের ৭ থেকে ৮ টনের ৩-৪টি গাড়ি প্রতিরাতে কাওরানবাজার আড়তে আসে।
এছাড়া খুলনার ফকিরহাট, বটতলা থেকে ২-৩টি, সাতক্ষিরা থেকে ৩-৪টি ৭ থেকে ৮ টনের ট্রাক বোঝাই হরিণা চিংড়ি, নলা, বাগদা, কাতল, কাটা টেংরা ও আরো কয়েক প্রকারের মাছ আসে এ আড়তে।
এছাড়া গোপালগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, বিক্রমপুর, নাটোর, চাঁদপুর, বরিশাল, শরীয়তপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ফরিদপুরের টেকেরহাট, বেন্নাবাড়ি, বাইন্নারচর, সাতপাড় প্রভৃতি স্থান থেকেও শিং, মাগুর, শোল, রুই, কাতল, মেনিমাছ, খৈলসাসহ বিভিন্ন দেশিয় প্রজাতির ছোটবড় মাছের বেশ কয়েকটি ট্রাকও আসে এ আড়তে ।
তবে সবচে’ বেশি মাছ আসে বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত কিছু মাছ থাকলেও এখানকার বেশির ভাগ মাছই খামারে উৎপাদিত। এই সময়ে প্রতিরাতে শুধু কাওরান বাজার আড়তেই আসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি ট্রাক। এসব মাছের মধ্যে পাঙ্গাস, তেলাপিয়া ও পিরানহা মাছের সংখ্যাই বেশি।
সারারাত ধরে এ মাছের আড়তে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সড়কপথে ও অন্যান্য মাধ্যমে আসা মাছ বিক্রি শুরু হয় ভোর ৫টা থেকে। মূলত: পাইকারি এ আড়তে মাছের বেচাকেনা চলে সকাল ৯টা থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। পূর্বে কিছু মফস্বল এলাকার মাছের পাইকাররা এ আড়ৎ থেকে মাছ কিনে নিয়ে বিক্রি করলেও এখন শুধু রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা মাছ বিক্রেতারা এ আড়ৎ থেকে মাছ কিনে নেন। কাওরান বাজারের এ মাছের আড়তের পৃথক পাঁচটি মার্কেটে কমপক্ষে আড়াই থেকে তিন হাজার শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
বর্তমানে গড়ে প্রতিদিন এ আড়তে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মাছ কেনাবেচা হয় বলে জানান মাছ ব্যবসায়ীরা। মাছ পচনশীল বস্তু হওয়ার কারণে কখনো কখনো সামান্য লোকসান দিয়ে হলেও দিনের চালান দিনেই বিক্রি করে দিতে চান আড়তদাররা।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মাছে কোনো ফরমালিন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না বলে দাবি করলেও, ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা মাছে ফরমালিন ব্যবহার হয় বলে স্বীকার করেন এ আড়তের মাছ ব্যবসায়ীরা।
কাওরান বাজার মাছের আড়ৎ ঘুরে রাজধানীর সবচে’ প্রাচীন মাছের আড়ৎ বুড়িগঙ্গা তীরের সোয়ারিঘাটে গিয়েও চাষ করা মাছ সরবরাহের আধিক্য দেখা যায়।
সেখানকার মাছের আড়তদাররা জানান, একই রকম তথ্য।
এ আড়তের অন্যতম ব্যবসায়ী গোলাম হোসেনের কর্মচারী শফিকুল ইসলাম (২৪), প্রায় এক যুগ ধরে রাতে মাছ উঠানামার কাজ করে থাকেন।
তিনি জানান, এ আড়তে পাঙ্গাস মাছের পাইকারি মূল্য ১০০-১২০টাকা, রুই-কাতল ২০০-২৫০ টাকা। তবে সবচে’ বেশি দাম চিংড়ি ও আইর মাছের। প্রকারভেদে এ দু’টি মাছের কেজি সর্বোচ্চ ১২শ’-১৫শ’ টাকা। পূর্বে একসময় এ আড়ৎ সবচে’ জমজমাট হলেও বর্তমানে কিছুটা ম্লান হয়েছে এর পূর্বেকার জৌলুস। বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ জন আড়তদার রয়েছে সোয়ারিঘাট মাছের আড়তে। বেচাকেনা এ মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা।
এখানকার আড়তদাররা আরো জানান, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, কচুক্ষেতসহ অন্য ছোট বড় মাছের আড়তগুলোতেও কমেছে প্রাকৃতিক উৎসের মাছের সরবরাহ। বেড়েছে খামারে উৎপাদিত মাছের সরবরাহ।
এর ফলে প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত মাছকে ঘিরে বাঙালি হাজার বছর ধরে যে রসনা বিলাসে অভ্যস্থ, তার বিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়তো করার থাকছে না!
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৩
এআই/সম্পাদনা: জনি সাহা, নিউজরুম এডিটর