ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

মানুষ ও পশু মিলে মিশে বসবাস!

মফিজুল সাদিক ও ইমরান আলী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:০৩, জানুয়ারি ২৯, ২০১৩
মানুষ ও পশু মিলে মিশে বসবাস!

ঢাকা: ঢাকা মহানগরীর ১১টি হরিজন কলোনিতে হরিজন সম্প্রদায়ের প্রায় ২২ হাজার মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলেও বছরের পর তারাই বসবাস করছেন অপরিচ্ছন্নতার ভেতরে।

একই চুলায় দুই থেকে তিনটি পরিবার পালাক্রমে রান্না করে। কোনো পরিবারেই নেই কোনো পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা।

অপরিচ্ছন্ন এসব হরিজন কলোনিগুলোতে তাই সব সময় নানা ধরনের রোগের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয় হরিজনদের।

মঙ্গলবার সরেজমিনে হরিজন কলোনিতে গিয়ে এ করুণ চিত্র দেখা গেছে।

নাজিরাবাজার হরিজন পল্লীর বাসিন্দা লক্ষী রাণী তিন ছেলে ও তাদের সংসার নিয়ে ছোট একটা দুই রুমের মধ্যে বসবাস করে আসছেন বছরের পর বছর। পরিবারটির সঙ্গে বসবাস করছে ৫টি ছাগলও।

লক্ষী রাণীর বসবাসের রুমের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ময়লাযুক্ত নোংরা পানির স্রোতধারা।

এ সম্পর্কে লক্ষী রাণী বাংলানিউজকে বলেন “ কি করুম ছোট্ট একটি খুপরির ভেতরে আমাগোর বসবাস করন লাগে। লগে পাঁচটি ছাগলও বসবাস করে। ’’

‘‘আমরা অন্যকে পরিষ্কার রাহি। কিন্তু আমরা কিভাবে থাহি, এইডা কেউ দ্যাহে না। ”

শুধু লক্ষী রাণীই নন, তার মতোই এ হরিজন কলোনির সকলেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এখানে নেই কোনো স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট। নেই কোনো মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা। হরিজন পল্লীর সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হচ্ছে, আবাসন সমস্যা। কলোনিগুলোতে নেই কোনো পয়:নিষ্কাশনের সুব্যবস্থাও।

 
একটি রুমের ভেতরে দুই থেকে তিনটি পরিবারের এক সঙ্গে বসবাস করতে দেখা গেছে নাজিরাবাজর ও হাজারীবাগ হরিজন কলোনিতে।

বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, সারা বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ হরিজন সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীর ১১টি হরিজন কলোনিতে প্রায় ২২ হাজার হরিজন সম্প্রদায়ের লোক বসবাস করেন।

ঢাকাসহ সারা দেশের ১৫ লাখ হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনই চাকরি, শিক্ষা, বাসস্থান ও স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

সমাজের এসব অবহেলিত মানুষের দাবি, বিভিন্ন মহল হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনকে চাকরি না দিয়ে অহরিজন সম্প্রদায়ের লোকেদের চাকরি দিচ্ছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে এখানকার ছেলে-মেয়েরা।

নাজিরাবাজার হরিজন কলোনিতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ৩ হাজার লোকের বসবাস। অথচ স্কুল মাত্র একটি। এ স্কুলে ১৫০ জন শিক্ষার্থীকে পড়াশুনা করানো হয়।

হরিজন সম্প্রদায়ের মহাসচিব নির্মল চন্দ্র দাস বাংলানিউজকে বলেন, “এখানো কোনো মানবতা নেই। যেখানে মানুষ ও পশু মিলে মিশে এক সঙ্গে বসবাস করে সেখানে মানবতা থাকতে পারে না। ’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় আমাদের কেউ কাজে নেন না। অথচ অহরিজনরা এসে এ জায়গাগুলোও দখল করে নিচ্ছেন। ”

২০১১ সালের এপ্রিল মাসে সরকার নীতিমালা তৈরি করেছিল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে হরিজনদের জন্য ৮০ শতাংশ কোটা থাকবে। কিন্তু সে নীতিমালা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

এসব সমস্যা ছাড়াও হরিজন কলোনিতে সন্ধ্যার পরপর  ইয়াবা, ফেনসিডিল মদ, গাজা ও জুয়ার আড্ডা বসে। অহরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্নভাবে হরিজনদের ব্যবহার করে এ সমস্ত ব্যবসা করে আসছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায় পোস্তগোলা, মিরপুর, রায়েরবাজার, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর ও ওয়ারী হরিজন কলোনিতে নেশা জাতীয় দ্রব্যের জমজমাট ব্যবসা চলে।

নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবসার কথা বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করে বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণ লাল  বলেন, “সন্ধ্যার পর বিভিন্ন ধরনের মদ ও গাজায় হরিজন কলোনিগুলো ভরে যায়। অহরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা এসব ব্যবসা করেন বলে তা বন্ধ করা যায় না। ’’

নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, “হরিজন কলোনিগুলোতে হরিজনরা যেভাবে বসবাস করেন, কোনো সভ্য সমাজে এভাবে বসবাস করা যায় না। ’’

‘‘ঢাকা নগরীকে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতা করছেন। অথচ রাষ্ট্র তাদেরই অপরিষ্কারে নিক্ষেপ করেছে। আজকে আমরা যারা তিন থেকে চার রুমের ফ্ল্যাটে বসবাস করছি, হরিজনদের বর্তমান অবস্থা দেখে আমাদের নিজেদেরকেই বড় অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। ’’

ড. মিজান বলেন, ‘‘রাষ্ট্র তাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে, এ অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না। আমি প্রধানমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে দৃষ্টি আর্কষণ করবো। যাতে করে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকেরা নূন্যতম মৌলিক চাহিদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। ”

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৩
এমআইএস/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর- eic@banglanews24.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।