ঢাকা : বসে আছি আরব সাগরের তীরে। তখনও সন্ধ্যা নামেনি।
দুচার কথার মধ্য দিয়ে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো ডায়মন্ডের সঙ্গে। ওর জিজ্ঞাসা- এই নিয়ে মুম্বাই কতবার এলেন? বললাম, বম্বে যখন নাম ছিল তখনই একবার এসেছিলাম। ডায়মন্ড বললো, মহারাষ্ট্র ভ্রমণ শুরু করা যায় দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী এই মুম্বাই থেকে।
এখানের গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া থেকে লঞ্চে চেপে আরব সাগরের বুকে এলিফ্যান্ট গুহা দেখে আসা যায়। মুম্বাইয়ে দিন দুয়েক থেকে এগিয়ে যেতে পারেন মাথেরন, পুনে হয়ে মহাবলেশ্বরের দিকে।
অথবা কোংকন তট ধরে চলে যাওয়া যায় হরিহরেশ্বর বা তারকাবলির নিরালা সৈকতে। আওরঙ্গাবাদে দিন দুয়েক থেকে দৌলতাবাদ দুর্গ দেখে ফিরতে পারেন কলকাতার দিকে।
ডায়মন্ডকে বললাম, তোমার কথা অনুযায়ী এভাবেই ভ্রমণটা সেরে নেবো। ও বললো, ছবিপাড়ায় কি যাবেন না? বললাম, গিয়ে কি হবে। আমরা যাদের ছবি দেখতাম সেই অশোক কুমার, দেব আনন্দ, সুরাইয়া, বেগম পারা, শাম্মী কাপুর, রাজকাপুর, নূরজাহান এরা তো কেউই বেঁচে নেই।
এদেরকে দেখতে পাবো না আর কোনদিন তাই ফিল্ম পাড়ায় যেতে চাই না। ডায়মন্ড একটু হেসে বলল কেন, সালমান খানতো এখন টপ নায়ক তাকে না হয় দেখবেন। বললাম, তাকে তো একবার হায়দ্রাবাদের এক অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম।
ওই যে একবার কাছ থেকে দেখেছি এটা যথেষ্ট নয় কি? পরদিন এমটিডিসির হাফ ডে প্যালেস ট্যুরের বাসে ঘণ্টা চারেকের জন্য বেরিয়ে পড়লাম মুম্বাই শহর দেখতে। সঙ্গে ছিল ডায়মন্ড। একে একে দেখানো হলো- মেরিন ড্রাইভ, গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া, হ্যাথিং গার্ডেন, কমলা নেহেরু পার্ক, টাওয়ার অব সাইলেন্স, মণি ভবন, তারাপোরওয়ালা একোরিয়াম, প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়াম প্রভৃতি।
মেরিন ড্রাইভে যখন দাঁড়িয়ে আরব সাগর দেখছিলাম তখন গাইড জানালেন, এই মুম্বাইতে ওভাল ময়দান ও আজাদ ময়দান ঘিরে রয়েছে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়, রাজা বাঈ বসুক টাওয়ার, হাইকোর্ট, পুরনো সেক্রেটারিয়েট, রাজ্য পুলিশের সদর দফতর ইত্যাদি।
এমনকি ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসও। ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বা ভিটি নামে যা আজও পরিচিত। এই স্টেশনটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত। ভিটি থেকে সোজা গেলে ফ্লোরা ফাউন্টেন, বর্তমান নাম ‘হুতাত্মা চক’। এই চকের কাছেই অবস্থিত মুম্বাইয়ের বিখ্যাত শেয়ারবাজার।
‘শেয়ারবাজার’ নামটি শুনে ডায়মন্ডকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মুম্বাইতে শেয়ার বাজারে কি ধস নামে? ও বললো, শেয়ারবাজারে ধস নামলো কি নামলো না এ নিয়ে কেউ শঙ্কিত থাকে না।
কারণ, এখানকার লোকরা মনে করে শেয়ার মানে জুয়া খেলা। জয় আছে, পরাজয় আছে এসব মনে করেই লোকজন এখানে টাকা খাটায়। কারো লোকসান হয়, কারো লাভ হয়। শুনেছি বাংলাদেশে শেয়ার নিয়ে মারামারি হয়, আন্দোলন হয় এই মুম্বাইতে কিন্তু ওইসব নেই।
আমার জিজ্ঞাসা- ‘লস খেলে এখানকার লোকজন চুপচাপ থাকে কেন?’ ডায়মন্ড বললো, ওই যে বললাম, এখানকার লোকজন শেয়ারকে মনে করে জুয়া- জুয়া খেলা।
বিকেলে এলাম এক ফিল্ম স্টুডিওর সামনে। এই স্টুডিওটি মুম্বাইর মালাবার হিলে। দাঁড়িয়ে আছি, দেখি গাড়ি থেকে নামলেন একজন। মনে হয় এর ছবি অনেকবার দেখেছি। নামটা স্মরণে আসছিল না। ডায়মন্ড বললো, উনি তো ‘রনধীর কাপুর’। রাজ কাপুরের বড় ছেলে।
এই রনধীর কাপুরের মেয়ে কারিনা কাপুরতো এখন টপ নায়িকা। দূর থেকে রনধীর কাপুরকে দেখে মনে হলো, কথা না বলেছি তাতে কি, দেখলামতো রাজকাপুরের বড় ছেলে রনধীর কাপুরকে।
ওখান থেকে ট্যাক্সিতে হোটেলে যাওয়ার পথে বারবার মনে পড়লো সেই কবে ১৯৮০ সালে প্রথম মুম্বাই শহরে আসার খন্ড খন্ড কত না স্মৃতি। তখন তো নাম ছিল বম্বে। এক স্টুডিওর সামনে গাড়িতে উঠতে দেখেছিলাম অশোক কুমারকে।
দূর থেকে দেখা- কাছে যেতে সাহস পাইনি। আমাদের শৈশব কালে অশোক কুমার তো ছিলেন হার্ডথ্রব নায়ক। তার অভিনীত চন্দ্রশেখর, হসপিটাল, মহল, ইজ্জত, বন্ধন, সাবিত্রীসহ কত না ছবি দেখেছিলাম। আজ তিনি তো মুম্বাইবাসীর কাছে ধূসর স্মৃতি।
প্রায় ১২ বছর হয় এই অশোক কুমার মারা গেছেন, তারপরেও তাকে ভুলিনি। ভুলবোই বা কেমনে। মুম্বাই গিয়ে তাই এবারও মনে হয়েছে এতো চিত্র তারকাদের শহর। শাহরুখ খান, সালমান খান, কারিনা কাপুর, শহিদ কাপুর, রানী মুখার্জি, প্রীতি জিনতা, ক্যাটরিনা, বিপাশা বসু, আমির খানসহ আরও কত শত চিত্র তারকার নগরীই এই মুম্বাই।
মুম্বাইর এলিফ্যান্টায় এসে জানলাম, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্বীকৃতি পাওয়া এলিফ্যান্টার খ্যাতি ৪৫০ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি খোদাই করা গুহা মন্দিরের জন্য। এলিফ্যান্টায় এলাম লঞ্চে করে। এরপর ট্রেনে উঠে এলাম পাহাড় শীর্ষে।
ওখানে নেমে দেখি দুধারে অজস্র দোকান এবং বেশকিছু রেস্টুরেন্ট। পাহাড়ের ওপরে রয়েছে মহারাষ্ট্র পর্যটনের ডে সেন্টার। সামনের দিকে অবস্থিত প্রধান গুহাগুলোই বেশি আকর্ষণীয়। সেখানে এসে দাঁড়ালাম আমি ও ডায়মন্ড।
কথায় কথায় ডায়মন্ড বললো, বরিভেলিতে গেলে দেখবেন সঞ্জয় গান্ধী ন্যাশনাল পার্ক। ওখানে লেক সমেত বিশাল এলাকা পিকনিকের জন্য রাখা আছে। আছে গাছ, বাড়ি ও মাটি থেকে অনেক উঁচুতে গাছ থেকে গাছে লাগানো বাঁশের সাঁকো। শীতকালে ওখানে লম্বা লাইন পড়ে যায় ...। মুম্বাই সম্পর্কে এভাবে নতুন নতুন তথ্য শুনে আরও মুগ্ধ হয়ে উঠলাম।
মুম্বাইতে গিয়ে উঠেছিলাম হোটেল মানামায়। ভাড়া ছিল ৫০০ টাকা। এছাড়া মুম্বাইতে আর যেসব হোটেল দেখেছিলাম তাহলো হোটেল সি সোর, হোটেল সি লর্ড, পপুলার প্যালেস, হোটেল নিউ বেঙ্গল, হোটেল ড্রিমল্যান্ড, হোটেল প্রিন্স, হোটেল সিটি প্যালেস, ঈশ্বর গেস্ট হাউস প্রভৃতি।
কলকাতার হাওড়া থেকে এই মুম্বাইতে গিয়েছিলাম গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে। এটি বেলা ১টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে পরদিন রাত ৯টা ২০ মিনিটে গিয়ে মুম্বাই এসে পৌঁছেছিল। পরদিন সকালে ট্রেনে করে রওয়ানা হলাম আওরঙ্গাবাদের দিকে।
ট্রেনে মানমাড জংশনে নেমে ট্রেন বদল করে উঠলাম আওরঙ্গাবাদের ট্রেনে। মানমাড থেকে যে ট্রেনটিতে উঠেছিলাম তার নাম হলো দেবগিরি এক্সপ্রেস। আওরঙ্গাবাদে এসে উঠলাম হোটেল পঞ্চবটীতে। ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা। ওখানে আর যেসব হোটেল দেখেছিলাম তাহলো হোটেল শিবশান্তি, রিজেন্ট প্লাজা, হোটেল মানস, হোটেল সফর, হোটেল রবিরাজ, হোটেল ক্লাসিক প্রভৃতি।
হোটেলে শুয়ে বারবার মনে পড়ছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কথা। রাত ১০টায় এসে পৌঁছলাম আওরঙ্গাবাদে, তাই পরদিন দেখবো আওরঙ্গাবাদ শহর এ নিয়ে কতোই না ভাবনা।
আগেই জানতাম, ঐতিহাসিক শহর আওরঙ্গাবাদ। শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মালিক অম্বর। পরদিন সকাল হতেই বাথরুমের যাবতীয় কাজ সেরে নাস্তা খেয়ে বের হলাম আওরঙ্গাবাদ শহর দেখতে। প্রথমে এলাম গুহার কাছে।
এই গুহাতো ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত। ১০টি গুহা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রয়েছে এখানে। এই গুহা দেখতে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটলাম। এবার অটো ভাড়া করে ছয় কিলোমিটার দূরে এলাম আওরঙ্গজেবের প্রথম বেগম রাবিয়া-উদ-দুররানির কবর দেখতে।
এটির নাম ‘বিবি কা মকবরা’। তাজমহলের অনুকরণে তৈরি এটি। একজন গাইড জানালেন, বিবি কা মকবরার মুখ্য স্থপতি উস্তাদ আতা উল্লা। বিবি কা মকবরায় ঢুকতে প্রবেশ মূল্য নেয়া হলো পাঁচ টাকা। একজন জানালেন, শুক্রবার বিবি কা মকবরা দর্শন করতে কোনও প্রবেশ মূল্য লাগে না।
বিবি কা মকবরা দেখে চললাম পানি চাক্কি দেখতে। মালিক অম্বরের পরিকল্পনায় এটি তৈরি হয়েছিল। এর চত্বরেই দেখলাম মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সূফি ধর্মগুরু বাবা শাহ মুসাফিরের সমাধি। দৌলতাবাদ দুর্গে যখন এলাম তখন বেলা ২টা বেজে গেছে। ওখানে এক রেস্টুরেন্টে ডাল পরাটা খেয়ে নিলাম।
সেখানেই পরিচয় হলো ষোল বয়সী ‘আনন্দ রায়’ নামে এক ছেলের সঙ্গে। সেও যাচ্ছে আওরঙ্গজেবের সমাধি দেখতে। আমি বরলাম, আমিও তো যাচ্ছি সেদিকে। আনন্দ রায় আমাকে বুকে জড়িয়ে- বাহ আমাদের দুজনার মধ্যে কতই না মিল।
অটো ধরে আমি ও আনন্দ এলাম খুলদাবাদে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধির কাছে। দোর্দন্ড- প্রতাপ ভারত সম্রাট আওরঙ্গজেবের এমন অনাড়ম্বর সমাধি দেখে বিস্মিতই হলাম।
আনন্দ রায় আর আমি ওই সমাধির কাছে প্রায় ১৫ মিনিট সময় কাটালাম। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম আওরঙ্গাবাদ শহরে। আনন্দ রায় চলে যাওয়ার সময় বললো, ‘আমি তো নাগপুর থেকে এসেছি। কালকে চলে যাচ্ছি ...। যাবেন ওখানে। ‘
নাগপুরের কথা বলতেই মনে পড়লো সজল মাতবরের কথা। সজল ছিল আমার বাল্যকালের বন্ধু। পিরোজপুর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে আমরা ১৯৬১ সালে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়েছিলাম। ১৯৬৮ সালে সজল চলে গেল নাগপুরে ...।
অনন্ত রায় বললো, কি ভাবছেন? বললাম, বন্ধু সজলের কথা। শুনেছি সে নাগপুরে আছে। ও বললো, ঠিকানা বললে সজলের কাছে নিয়ে যাবো। ওকে বললাম, তোমার মোবাইল নাম্বারটা দাও। ফের যখন আসবো তখন না হয়ে যাবো নাগপুরে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৩
সম্পাদনা : হাসান শাহরিয়ার হৃদয়, নিউজরুম এডিটর, সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর