কাদের মোল্লার রায়ের পরপরই শাহবাগের রাস্তায় দুটি ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ জানায় কয়েকজন তরুণ। সময়ের স্রোতে তাদের দলে যোগ হয়ে গেল দেশের তরুণ প্রজন্ম।
মাঠে, রাস্তায়, ফেসবুকে, ব্লগে সব জায়গায় তরুণদের উত্থান দেখে মুগ্ধ সব স্তরের মানুষ। তারুণ্য জেগেছে। সবাই স্বপ্ন দেখছে তারুণ্যের জোয়ারেই ধুয়ে মুছে যাবে বাংলার কলঙ্ক।
স্বপ্নযাত্রার পক্ষ থেকে কয়েকজন তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হছিল শাহবাগের এ আন্দোলন নিয়ে। তাদের মতামত নিয়েই এ আয়োজন।
সামনুম সুলতানা
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি

সেই সঙ্গে যত যুদ্ধাপরাধী আছে তাদের বিচার করতেই হবে। এদেশে আর একটিও রাজাকার যাতে বেঁচে না থাকে। এ দাবি তো একদিনের নয়। দীর্ঘদিনের দাবি। দীর্ঘসময়ের পর আজ সবাই একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছে। আমাদের গর্জন শুনতে পাচ্ছে বিশ্ববাসী।
সমস্যার তো শেষ নেই। অসংখ্য সমস্যা আছে। প্রতিদিন হত্যা হচ্ছে, খুন হচ্ছে, দুর্নীতি হচ্ছে এসব কিছু নিয়েই আমাদের বসবাস। এতো সব সমস্যা সহ্য করতে করতে আমরা অস্থির হয়ে গেছি। এখন যদি দেখি এই দেশদ্রোহীরা শান্তির নিশ্বাস নিতে পারছে তখন কি নিজেকে আটকে রাখা সম্ভব?
তরুণদের এ গর্জে ওঠার অপেক্ষাতেই ছিল সবাই। এখনই সুযোগ এ রাজাকারদের অবিলম্বে ফাঁসির ব্যবস্থা করা। আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের রাজনীতিবিদরা এটিকে একটি রাজনৈতিক রঙ দেওয়ার চেষ্টায় আছেন।
তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, একবার এসে শাহবাগ ঘুরে যান। এখানে আমাদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। আমাদের একটাই পরিচয়। আমরা বাঙালি।
তাশফী মাহমুদ
সংগঠক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র

১৯৭১ সালের রক্তঋণ পরিশোধে আমরাই নিবেদিত প্রাণ। যখন একবার জেগে উঠেছি, তখন কেন আর ঘুমিয়ে যাবো না। তাই তো এখন আমাদের গন্তব্যস্থল প্রজন্ম চত্বর।
ইনশাল্লাহ। আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হবো । কারণ আমাদের পূর্বপুরুষরা হেরে যায়নি। আমরা বাঙালি। হেরে যাওয়া কাকে বলে আমরা জানি না। জানতে চাইও না।
স্পষ্টভাবে সবাইকে একটা কথা বলতে চাই যে- এই আন্দোলন আমাদের। কারো ব্যক্তিগত বা দলীয় আন্দোলন নয় । তাই যে তরুণ এখনও ঘরে বসে আছে তারা চলে আসুন প্রজন্ম চত্বরে।
হাজার হাজার মানুষের স্লোগানে আপনিও মুগ্ধ হয়ে যাবেন। এ চেতনাবোধ একদিনে জ্বলে ওঠেনি। দীর্ঘসময় বুকের ভেতর জমানো ক্ষোভের প্রকাশ।
দেশ আমাদের সবার , তাই মাতৃভূমির প্রয়োজনে লড়তে হবে আমাদেরই।
এলো বসন্ত দিলোরে ডাক, রাজাকার নিপাত যাক।
কোকিল বলছে কুহু রবে, রাজাকারের ফাঁসি হবে।
শেহরীন আতাউর খান
ছাত্রী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়আমরা কম্পউটারে খাই, কম্পিউটারে ঘুমাই প্রজন্ম। আমরা ফেসবুক জেনারেশন। ঠিকাছে মানলাম বড়দের কথা। আমরা লাইক দিতে জানি। বিপ্লব করতে জানি না। মানলাম বড়দের কথা।
আমরা ডিজিটাল জেনারেশন কম্পিউটার আর ফেসবুকে রেখে এখন রাস্তায় নেমেছি। তবে অন্য সবার মতো নয়। গাড়ি ভাঙচুর করতে নয়, গাড়ি পুড়িয়ে দিতে নয়, ক্লাস বাতিলের কোনো স্লোগানও নয়।
আমরা মাঠে এসেছি রাজাকারদের ফাঁসি চাইতে। আমাদের দাবি একটাই। আর কোনো দাবি নাই।
একজন নৃশংস হত্যাকারী, অমানুষের রায় যখন ফাঁসি হয় না। আর সেই শাস্তিকে যখন ‘লঘু পাপে গুরু দণ্ড’ অথবা ‘বিনা পাপে ভয়ানক দণ্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে সমগ্র দেশে হরতাল পালন করা হলো তখন কি ধৈর্য্যের বাঁধ অটুট থাকে? তখন তো সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে রাজপথই ঠিকানা হয়ে পড়ে।
আমাদের প্রতিবাদের বিষয় খুব স্পষ্ট। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই।
আর একটা কথা আমাদের রাজনীতিবিদদের বলে যেতে চাই। আমরা কোন রাজনৈতিক দলের থেকে আসিনি। আমরা কোনো দলীয় নেতা হওয়ারও শখ নেই। আমরা কোনো স্বার্থ নিয়ে শাহবাগে নির্ঘুম রাত কাটাই না। আমাদের জন্য ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ সমস্ত স্লোগান সমান।
ইশতিয়াক মাসরুর তৌসিফ
এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজকবে থেকে নাওয়া খাওয়া নেই। তবুও কেউ দমাতে পারেনি। তারা মারামারি কাটাকাটি করেনি। যে মেয়েটি এতদিন ঘর পালাতো প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে, সে আজ ঘর পালিয়েছে আন্দোলন করতে।
পাড়ার সবচেয়ে পড়ুয়া ছেলেটি, যাকে সবাই আঁতেল বলে খ্যাপাতো সেও আজ পড়ার বইটি রেখে চলে এসেছে ইতিহাসের সাক্ষী হতে।
সেই ঘর পালানো মেয়েটি আর আঁতেল ছেলেটি একসঙ্গে হয়ে গেয়েছে গান। আবৃত্তি করেছে কবিতা। গলা ভেঙ্গে ফেলেছে স্লোগান দিতে দিতে। গলা থেকে যখন আর শব্দ বের হচ্ছিল না তখনও তারা দমেনি।
কিছু মানুষ এসেছিলো তাদের এই ‘পাগলামি’ দেখতে। দেখতে এসে তারাও নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। নিজের অজান্তে চিৎকার করে বলে ফেলেছে ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’। ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘরে ফিরবার সময়ও তারা গুনগুন করছিলো ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’।
বাসায় ফিরেও কেউ দমে যায়নি। মোবাইলে, ব্লগে, ফেসবুকের ওয়ালে, চ্যাটবক্সের আড়ালে, স্ট্যাটাসে, কমেন্টে সব জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছে এই গান, এই কবিতা, এই স্লোগানগুলো।
এখানে এসে কেউ নতুন বন্ধু বানায়নি। পাশের অপরিচিত ছেলেটিকে একজন বন্ধু হিসেবে দেখেনি, দেখেছে সহযোদ্ধা হিসেবে। কেউ বলে তারা নাকি হুজুগে মাতাল। আর আমি বলি, তারা রচনা করছে নতুন ইতিহাস।
মুহতাসীম দাইয়ান
এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ঢাকা সিটি কলেজ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’ স্লোগানে কয়েকজন তরুণের শুরু করা প্রতিবাদ আজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
জাতি আজ আপ্লুত। অনেকদিনের ক্ষোভ ঝড়ে পড়ছে এই তরুণদের স্লোগানে। সবাই আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। কোলের অবুঝ শিশুটিও বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে এই প্রতিবাদে। জাতিগতভাবে এরচয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে?
গণমানুষের আশা-আকাংখা এখন শুধু একটাই- যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি। শাহবাগে অবস্থানরত কেউ কোনো লোভে জোড়ো হয়নি। দেশের টানেই উত্তাল হয়েছে শাহবাগ।
এই প্রজন্মের একজন হতে পেরে আমি গর্বিত। আমরা আজ এক নতুন দিনের সূচনা করেই ছাড়বো।
লাখো শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেব না। বাংলা মায়ের সন্তানরা হারতে জানে না…
বাংলাদেশ সময়: ২০১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৩