ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

শাহ আবদুল করিমের গুরু ইব্রাহিম মস্তান

মাজেদুল নয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৩২, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৩
শাহ আবদুল করিমের গুরু ইব্রাহিম মস্তান

বাংলা বাউল গানের কিংবদন্তী শাহ আব্দুল করিমের গান ভাটি অঞ্চল ছাড়িয়ে, দেশের সবপ্রান্তে সমান জনপ্রিয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল করিমের জন্মবার্ষিকী।

১৯১৬ সালের এই দিনে সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামেই তার অনুসারী-ভক্তকুল তাকে স্মরণে লোক উৎসবের আয়োজন করে। উজানধল থেকে লিখেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মাজেদুল নয়ন। ছবিতে আছেন ডেপুটি চিফ ফটো করেসপন্ডেন্ট নাজমুল হাসান।
 
উজানধল থেকে: তোরা আও আও রে, আশেক ভক্ত ভাই, ইব্রাহিম মস্তান সাহেবের, গুণগান গাই—গুরু ইব্রাহিম মস্তানকে এভাবেই লালন করেছেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম।
 
শনিবার দুপুরে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে বাংলানিউজের সঙ্গে আড্ডা হয় বাউল সন্তান শাহ নূরজালালের সঙ্গে। বাড়ির সামনের মাঠে তখন চলছে বাউল সম্রাটের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লোক উৎসব। তার ভক্ত-মুরিদানের আগমনে উজানধল এখন উৎসবের আমেজে।

জালাল বলেন, “বাবা তার ওস্তাদ ইব্রাহিম মস্তানের পরিচয় দিয়েছেন, ‘বিশ্বনাথ থানায় বাড়ি, শ্রীপুরে বাসা, পশ্চিম দিকে হাসন রাজার, রঙ্গের রামপাশা। ”
 
আবার বলেছেন, “মুর্শিদ মৌলা বক্স মুন্সি, লি ইমানে জানি, ইব্রাহিম মস্তান সাহেবকে পীর বলিয়া মানি। ’
 
জালাল বলেন, “মায়ের মৃত্যুর পরে পিতা ছাড়া আমার আর আপন বলে কেউ ছিলেন না। আমি পিতার কাছেই মাতা পিতার মায়া মমতা পেতাম। পিতা আমাকে আদরে-স্নেহে-আবেগে আপ্লুত হয়ে কখনো বাবা, কখনো বাজান আবার কখনো আব্বাজান ডাকতেন। ”
 
তিনি বলেন, “কালনী তীরে দাঁড়িয়ে সুরের ভুবনে হারিয়ে যেতেন পিতা। গুনগুন করে গাইতেন নিজের গান। কাছে কাছে থাকতাম আমি। তিনি গাইতেন মানুষের জন্যে। যেখানেই গেছেন, সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। ”

জালাল বলেন, “মানুষ ভোটের রাজনীতির বক্তৃতা শোনার জন্য না আসলেও আমার পিতার গান শোনার জন্য ঠিকই আসতেন। নেতারা বক্তৃতা লম্বা করতে চাইলে সাধারণ মানুষ বলতো, সাহেব আপনার বক্তৃতা লাগবে না, ভোট আপনাকেই দেবে। আমরা করিম ভাইয়ের গান শুনতে চাই। ”
 
জালাল বলেন, “বয়সের শেষ দিকে পিতা যখন প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন, তখন মানুষ কাছে থাকলে শান্তি পেতেন। অনেক মানুষ আসতো ওনাকে দেখতে। জীবনের অগণিত সময় উনি কাটিয়েছেন মানুষের জন্য। পিতার সঙ্গে যখন ভক্তের বাড়িতে যেতাম, দেখতাম ভক্তরা বাবাকে ঘিরে বসতো। পিতা ধর্ম, সামাজিক, রাজনৈতিক আলাপ করতো। নৈশ বিদ্যালয়ে আট রাতের শিক্ষা ছিল। ”
 
বাবার জীবন সর্ম্পকে তিনি বলেন, “অভাব অনটনের সংসারে তিনিই ছিলেন একমাত্র পুত্র সন্তান। সংসারে হাল ধরতে চাকুরিতে যান। নৈশ বিদ্যালয়ে পাওয়া বড়দের শিক্ষার বই তার সঙ্গী হয়। পড়তে পড়তে তিনি অক্ষর জ্ঞান অর্জন করেন। ”
 
গানের সুরে তিনি বলেন,
‘তখন ব্রিটিশ শাসন এই দেশে ছিল
বড়দের শিক্ষার জন্যে রাত্রে স্কুল দিল
বিনামূল্যে দিল একটি বড়দের বই
সুযোগ যেয়ে পেয়ে আমি সেই স্কুলে ভর্তি হই
পরে শুনি এই স্কুলে শিক্ষা যারা পাবে
নাম দস্তখত শেখার পরে যুদ্ধে নিয়ে যাবে। ’
 
পিতার, পিতামহের ছোট ভাই নছিব উল্লাহ ছিলেন একজন ফকির। জীবনের শেষদিকে রোগে-শোকে জর্জরিত হয়ে ঘরে বসেই লাউ বাজিয়ে গান গাইতেন।
‘ভাবিয়া দেখ মনে
মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে। ’
শুনতে শুনতে বাবা গান পাগল হয়ে ওঠেন। নানা সর্ম্পকীয় করম উদ্দিন ওস্তাদকে মান্য করে গানের তালিম নিতে থাকেন তিনি। দিনে গরু চরাতেন, রাতে গান গাইতেন।
 
পিতা বলছেন,
‘গরু নিয়ে প্রতিদিন হাওরে যাই
ঈদ শুভদিনেও আমার ছুটি নাই। ’
 
দাদার মৃত্যুর পর শুধু গান। বাড়িতে গড়ে তোলেন, বাউল শিল্পীদের আড্ডাস্থল। দেশ ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন তিনি।
 
‘নেত্রকোণার অর্ন্তগত বাইশ চাপরা গ্রাম
এই গ্রামে জন্ম সাধক রশিদউদ্দিন নাম
দেখা পেয়ে আনন্দে বিভোর হইলাম
শ্রদ্ধাভরে ওস্তাদের বাড়িতে রইলাম। ’
 
তিনি বলেন, “বিবাহের পর মা সরলা পিতাকে উদ্দীপনা জোগাতেন। আমি পিতার কাছেই সুহৃদ হই। প্রতিদিন ভক্ত মুরিদান পিতার কাছে আসতো এবং পিতাও প্রাণভরে সবাইকে ভালবাসতো। তার চেয়ে বেশি ভালবাসতেন মা সরলা বেগম। ”
 
তিনি বলেন, “মায়ের প্রতি পিতার ভালবাসা ছিল অনেক। সিলেট শহর থেকে বাড়িতে ফিরে স্ত্রী সরলা খাতুনের মরদেহ দেখে ‘সরলা’ বলে চিৎকার করে কান্না করেছিলেন বাবা। পরে সেই প্রেক্ষিতের গান লেখেন,
‘আসি বলে গেলো বন্ধু
আইলো না
যাবার কালে সোনাবন্ধু
নয়ন তুলে চাইলো না। ’
জালাল বলেন, “গণসঙ্গীত পরিবেশন করে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানহ অনেকের সান্নিধ্য পেয়েছেন। ”

গণসঙ্গীত নামে পিতার একটি বই বের হয়। পরিবারের শেষ অবলম্বন নয় কেদার (২৬ শতকে এক কেদার) জমি বিক্রি করে পিতা প্রকাশ করে ‘কালনীর ঢেউ’।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৩
এমএন/সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।