ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সামাজিক প্রজন্মের অরাজনৈতিক মঞ্চ

শেরিফ আল সায়ার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০২, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৩
সামাজিক প্রজন্মের অরাজনৈতিক মঞ্চ

বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ে আলোচকের অভাব নেই। একইভাবে দেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় রাজনীতি নিয়ে আলোচনাও হয় প্রচুর।

রাজনীতি করে রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক সমালোচক এমনকি বুদ্ধিজীবীও বনে যাচ্ছেন অনেকেই।

তবে দেশের রাজনীতিতে এখন গুণগত পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। রাজনীতিবিদেরা মনে করেন স্বৈরশাসক বিদায়ের পর থেকেই এ পরিবর্তন এসেছে। আর তখন থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা শুরু।

তবে এ চর্চায় পরিবর্তনটা কি এল? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই। নিতান্তই সাধারণ জনগণ হিসেবে সবারই প্রশ্ন বাংলাদেশের রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত। এখানে অবশ্য রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে রাজনীতিবিদদের দ্বৈরথ নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত।

তাদের এমন নীতির জন্যই দেশ অরাজকতার মুখোমুখি হয়। তাদের ভাষা ব্যবহারেও জনগণ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে এ বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়। ‘ষড়যন্ত্র করছে’, ‘জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে’, ‘জনগণ আমাদের পক্ষে আছে’, ‘জনগণ তাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না’, ‘জনগণকে বিভ্রান্ত করছে’ এসব কোড করা শব্দের চর্চায় মুখর এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন।

এসব বাক্য কিংবা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে জনগণের স্বার্থেই। কিন্তু কোন জনগণের জন্য এসব বাক্যের ব্যবহার হয়? তা জানা মুশকিল। এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলেও বিপাকে পড়তে হবে। টিভির নানান টক শোগুলোতে এমন প্রশ্ন করা হলে, তারা মূল আলোচ্য বিষয় এড়িয়ে অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার সূত্রপাত করেন। যা একপর্যায়ে নিজের দলকে বিশুদ্ধ এবং অপর দলকে অশুদ্ধ হিসেবে প্রমাণ করার দিকেই এগিয়ে যায়।

লেখার বিষয় হিসেবে নেওয়া হয় অনলাইনের ভাষা। আমরা সবাই জানি অনলাইন ভিন্ন জগৎ। একমাত্র ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই এমন ভাষার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। আর তাদের কাছে অফলাইন রাজনীতির ভাষা গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।

যারা মিডিয়াতে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির বুলি আওড়ান তারা হয় মানুষের কথা বোঝেন না আর তা না হলে বুঝেও না বোঝার ভান করেন। অথবা তারা কিছুই বোঝেন না বা বোঝার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেন না। শুধু নিজে যা বোঝেন তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

প্রসঙ্গত, অনলাইনে বাংলাভাষার চর্চা পাকাপাকিভাবে শুরু হয় সামহোয়্যার ইন ব্লগের মধ্যে দিয়েই। নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মানুষগুলোর মধ্যে বাংলা ব্লগের জনপ্রিয়তা পেতে খুব বেগ পেতে হয়নি।

বাংলা ব্লগে মানুষ তাদের মুক্তমত প্রকাশের প্রধানতম মাধ্যম কিংবা বলতে গেলে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করে আসছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ আরও বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া।
সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালিরা প্রবেশের শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অনলাইন কনটেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণ করার চেষ্টায় রত ছিল অনলাইনে থাকা মানুষগুলো।

তখন থেকেই যুদ্ধাপরাধী শক্তির সঙ্গে অনলাইনেই যুদ্ধ চালিয়েছে তারা। অনলাইন কনটেন্টে সমৃদ্ধ হয়েছে ইন্টারনেট জগৎ। জেনোসাইডের কথা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা এবং যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা এসব কিছু জানার জন্য অনলাইনের দুয়ার সদাই উন্মুক্ত।

এ প্রজন্ম পড়েছে। যা পড়েছে তা আবার তুলে রেখেছে অনলাইনে। নিজের ব্লগে। কিংবা যেকোনো বিতর্কিত ইস্যু নিয়ে তারা আলোচনা করেছে। কখনও কখনও সোচ্চার হয়েছে। এভাবেই অনলাইন জগতে তারা যুদ্ধ করে এসেছে তাদের ভাষায়।

কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে মিডিয়া যেভাবে সম্মান দেখিয়ে কথা বলে, ব্লগ কিংবা ফেসবুকে খোদ প্রধানমন্ত্রীর ভুল নিয়েও তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মানুষের মনের কথা একমাত্র সোশ্যাল মিডিয়াতেই সহজেই এবং তাৎক্ষণিক তুলে ধরা সম্ভব।

এ যুদ্ধ এখন অনলাইন ছাড়িয়ে এসেছে রাজপথে। সুতরাং যারা মনে করছেন এ জাগরণ হুট করেই ঘটে গেছে তারা ভুল করবেন। দীর্ঘদিনের অনলাইন আন্দোলনে সংগঠিত হয়ে স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করা প্রজন্ম রাজপথে নেমেছে। নতুনদের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিস্তার লাভ করেছে অনলাইনের হাত ধরেই। এজন্যই দীর্ঘ সময়ের সাইবার আন্দোলন মাঠে গড়িয়েছে।

রাজনৈতিক ইস্যু, সরকার কিংবা বিরোধী দলীয় কোনো নেতাকে সমালোচনা করা সহ সব কিছুতেই ফেসবুক স্ট্যাটাস কিংবা ব্লগের মাধ্যমে জোরালো জবাব শুরু থেকেই দিয়ে আসছে ব্লগাররা।

তবে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনে একটাই সুস্পষ্ট দাবি। তা সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি। এ আগুন এখন জ্বলছে দেশজুড়ে। যে আগুনের উত্তাপ বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সব বাঙালিদের মাঝেও। যে উত্তাপের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে মিডিয়া। যেখানে অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ।

আন্দোলনের সূত্রপাত
শাহবাগের আন্দোলনের মূল সূত্রপাত ফেসবুক থেকেই। একটি ইভেন্ট তৈরি করে সেখানে সবাই এসে জড়ো হন। ফেসবুকেই অনেকেই তখন পোস্ট করেন, শাহবাগে মানববন্ধন হচ্ছে। এক পর্যায়ে ফেসবুকেই অনেকে বলতে থাকেন, তরুণেরা শাহবাগের রাস্তা অবরোধ করেছে। নিমিষেই ছড়িয়ে যায় এ খবর। টিভি স্ক্রলেও সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে এ সংবাদ প্রচার হতে থাকে।

তবে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকাই এখানে সবচেয়ে বেশি। যারা সেখানে ছিলেন, তারা মোবাইলের মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিচ্ছিলেন, ফেসবুকে ছবি আপলোড করছিলেন। এতে করে যারা ঘরে ছিলেন তারা মনের ভেতর তৈরি হওয়া ক্ষোভ-হতাশা প্রকাশ করার তাৎক্ষণিক অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম পেয়ে যান।

আন্দোলনের তৃতীয় দিন আমারই এক ছোট বোন বলে বসে, ভাইয়া আজ শাহবাগ যাবো। টিভি দেখে ভাবছিলাম ঢাকার সব তরুণেরা এখন শাহবাগে। একমাত্র আমিই ঘরে আছি।

এ মন্তব্য থেকে বোঝা যায় মানুষের হৃদয় কিভাবে ছুটে গেছে শাহবাগের দিকে। সেখানে সেøাগানের জাদুকর লাকী আকতার মানুষকে চাঙ্গা রাখতে দিনরাত উদ্যোমী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেখানেই অনলাইনের ভাষায় কথা বলা মানুষগুলো বলতে শরু করল, ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’।

সত্যিকার অর্থে বাঙালির রক্তে এ স্লোগান মিশে আছে। কিন্তু ভয়ে কিংবা মনের হেয়ালে এ নিয়ে কারও ভাবা হয়নি। কিন্তু যখন একই বয়সের তরুণেরা মাঠে নেমে গেল। যখন ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারসহ অন্য সব গণমাধ্যমে এ বিষয়গুলো উঠে আসলো তখন যেন সবাই গণশক্তি পেল। সবাই তখন একবাক্যে বলে উঠলো, এবার ৪২ বছরের হিসাবটা নিতেই হবে।

অনলাইনে সোচ্চার আন্দোলন
এ ডিজিটাল প্রজন্ম সবার কাছেই অবহেলিত ছিল। তারা রাজনীতি নিয়ে ভাবে না। তারা দিনরাত ফেসবুকে পড়ে থাকে। তারা ঘরে বসে ব্লগিং করে রাজনীতিকে গালি দেবে। কিন্তু কখনও মাঠে আসবে না। এরা সারাদিন ঘরে বসে কিংবা ফাস্টফুড দোকানে গিয়ে বার্গার খাবে।

এরা নিত্যনতুন ফোন কিনবে, ল্যাপটপ কিনবে, দামি ক্যামেরা কিনে ফটোগ্রাফার হবে। এসব ভেবেই রাজনীতিবিদদের কাছে এ প্রজন্ম খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। যদিও ভোটের রাজনীতিতে তারা নতুন প্রজন্ম কথাটি ব্যবহার করে। যেকোনো জায়গায় তরুণদের কাজ খুব কমই চোখে পড়ে। কিন্তু শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের নতুন অরাজনৈতিক ভাষা মুহূর্তেই পাল্টে দিয়েছে এসব ধারণাকেই। দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও একথা আজ গর্বের সঙ্গেই বলছেন।

বাংলাদেশ সময় ২০৫৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৩
সম্পাদনা: সাব্বিন হাসান, আইসিটি এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।