ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

সদ্য বিদায়ী শীতে শ্যামল গ্রামের পথে

লিয়াকত হোসেন খোকন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৩০, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩
সদ্য বিদায়ী শীতে শ্যামল গ্রামের পথে

দূরে কোথাও বেড়াতে যাব বলে ঢাকার সদরঘাট থেকে রাজদূত-৭ লঞ্চে উঠলাম। ঠিক করলাম এবারের ভ্রমণস্থান ভান্ডারিয়া।

লঞ্চ ছাড়ল সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে।

লঞ্চের বয় শফিকের জিজ্ঞাসা, ‘স্যার চা দিব?’ সম্মতি জানাতে মিনিট দশেক পরে চা নিয়ে উপস্থিত। লঞ্চে বসে দেখলাম বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে লঞ্চ এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম আকাশে মেঘের গর্জন।

বৃষ্টি আসবে; ঝড়োহাওয়া বইবেÑ পদ্মা-মেঘনায় গেলে লঞ্চ ভীষণ দোলাবে। এসব কথাই ভাবছিলাম। মিনিট দশেক সময় ধরে বৃষ্টি হয়ে থেমে গেল। রাত ১০ টায় খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম ভেঙে বাইরে তাকিয়ে দেখি স্বরূপকাঠিÑ এরপর লঞ্চ ভেড়াল ইন্দেরহাটে।

সন্ধ্যা নদী পেরিয়ে কাউখালী ঘাট দিয়ে কচা নদীর হুলারহাটে লঞ্চ এলো সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে। চিরচেনা সেই দৃশ্যই চোখে পড়লÑ ওই যে একদিকে কচা নদীর তীরে নারকেল-সুপারি গাছ। আর দূরে দেখা যাচ্ছে নদী এঁকেবেঁকে চলে গেছে শ্রীরামকাঠির দিকে।

নদীর যে কূলে তাকাই দেখি সবুজ শ্যামল প্রান্তর। নারকেল-সুপারি গাছের ফাঁকে ফাঁকে গাঁয়ের মেঠোপথ। লঞ্চঘাটের একটু পাশেই স্টিমারঘাট। লঞ্চ এখানে থেমে থাকল মিনিট বিশেক। বড্ড অস্থির হয়ে পড়ছিলাম, কখন সে লঞ্চ ছাড়বে।

এক সময় লঞ্চ ছেড়েও দিল। বিশাল কচা নদী হয়ে লঞ্চ এগিয়ে চলছে ভান্ডারিয়ার দিকে। পাঙ্গাশিয়া ছেড়ে অনেক দূরে এগিয়ে লঞ্চ ঢুকতে শুরু করল পোনাখালের দিকে। লঞ্চে বসেই দূরের চরখালী আবছা আবছা দেখলাম।

লঞ্চ থেকে নেমে চলে গেলাম ভান্ডারিয়ার বিউটি বোর্ডিংয়ে হোটেলে। ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচিত হয়েই বললাম, ভান্ডারিয়া দেখব বলেই যে এসেছি। কথাটা শুনে তিনি একটু হেসে বললেনÑ সুপারি বাগান, নারকেল বাগান আর পানের বাগান দেখবেন।

বড্ড ভালো লাগবে এই ভান্ডারিয়াকে। এখানের সবুজ শ্যামল গাঁয়ের রূপ আপনাকে ভীষণ আকৃষ্ট করবে। সবুজের মোহমায়ায় জড়িয়েও পড়বেন। বিকাল হওয়ার আগেই ভান্ডারিয়া দেখতে বের হলাম।

হেঁটে কিছু দূর যেতেই দেখতে পেলাম এক নির্জন গাঁয়ের পথ। আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ ধরে একটু এগিয়ে শুনি পাখির ডাক। মনে হয়, ওই বুঝি ঘুঘু ডাকছে। দেখি এক রাখাল ছেলে গরুর পাল নিয়ে এদিকে আসছে। ওদিকে দেখি এক গাছের তলে বসে এক তরুণ।

ওর কণ্ঠে গান চলছে। গানটা শেষ হতেই ওই তরুণকে জিজ্ঞেসা, ‘এ গান তুমি গাইছ কেন?‘ তরুণটি বলল, মনের কষ্ট মনেই থাক, নাই বা শুনলেন। সে তো ভারত চলে গেছে। ওরা যে, আর ফিরবে না। ওই যে দেখুন ওর বাবার সমাধি সৌধ। কথাগুলো শুনে একটু এগিয়ে দেখি খালে নৌকা।

এই মাঝি, কোথায় গেলে ভালো হয়? মাঝি বলল, বেড়াতে এসেছেন বুঝি, চলুন সিংহখালীর কাছাকাছি। ওদিকে গেলে নৌকায় বসে গাঁও-গেরামের রূপ দেখতে পাবেন । সিংহখালী যেতেই পড়ে কানুয়া, রাজপাশা, বানাই বাজার।

রাজপাশাকে কাছ থেকে দেখে না হয় ফিরবেন। নৌকায় উঠে বসলাম। মাঝি আফজাল নৌকা বাইছে, বললাম, তোমাদের দেশে এ সময় কী কী মাছ পাওয়া যায়। আফজাল বলল, মাছের দিন তো শেষ। নদীতে না আছে ইলিশ, না আছে বড় বড় পাঙ্গাশ, আইড়, গজার মাছÑ সবই তো বিলুপ্তির পথে।

ছোট খালের যেদিকে তাকাই দেখি নারকেল গাছের ছড়াছড়ি। কচুগাছও বেশ একটা চোখে পড়ল। হোগলা বনও চোখে পড়ল। আফজাল বলল, ওই যে হোগলা দেখছেনÑ এ দিয়ে পাটি তৈরি হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা নৌকায় বেড়ালাম।

এবার বটমূলের কাছে নৌকা ভিড়াল আফজাল মাঝি। বলল, এখান থেকে একটু দূরেই ভান্ডারিয়া বাজার। ফিরে এলাম বিউটি বোর্ডিংয়ে। রাত ৯টায় কাজী হোটেলে খেতে গিয়ে ইলিশ মাছ না পেয়ে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে ভাত খেলাম।

সর্বমোট খরচ হল ১৩০ টাকা। ম্যানেজার জানালেন, ভান্ডারিয়া থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে তেলিখালী, ধাওয়া ৪ কিলোমিটার, ভিটাবাড়িয়া ৫ কিলোমিটার, শিয়ালকাঠি ২ কিলোমিটার, সিংহখালী ১৫ কিলোমিটার, নদমুল¬া ৪ কিলোমিটার, মাঠিভাঙ্গা ৬ কিলোমিটারের যে কোনও দিকে যেতে পারেন।

পরদিন সকালে নৌকা নিয়ে চললাম চরখালীর অপর পাড়ের পারেরহাটে। নৌকায় এখানে পৌঁছতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লেগে গেল। পারেরহাটে নেমে রিকশা নিয়ে চললাম পিরোজপুরের দিকে।

পিরোজপুর হয়ে হুলারহাট গিয়ে অগ্রদূত প¬াস লঞ্চ ধরবÑ ওই লঞ্চেই ফিরব ঢাকায়। পিরোজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঈদগাহর পাশ থেকে রিকশা যাচ্ছেÑ হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে বলল, ‘আমি ল’ইয়ার সৈয়দ সাব্বির আহমেদ বলছি। চিনছেন তো, আমি তৎকালীন পাকিস্তান আমলের মন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের নাতি বলছি। আমি দেখতে পাচ্ছি আপনি যে রিকশায়। পি¬জ চলে আসুন।

সাব্বির আহমেদের কথা রাখার জন্য রিকশা ঘুরাতে বললাম চালককে। এবার ঢুকলাম সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের বাড়িতে। সাব্বির নিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার ক্ষণে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল অতীত কথা।

এই সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল ১৯১৪ সালে মহাত্মা  গান্ধীর আমন্ত্রণে অসহযোগ আন্দোলনে বক্তৃতা দিয়ে গ্রেফতার হন। তিনি ১৯৪৪ সালে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি পান। এরও আগে এই দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি সেই ১৯৩৯ সালে।

তিনিই তো ১৯৪৭ সালে ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। ১৯৫২ সালে সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের  খাদ্যমন্ত্রী। দোতলায় এসে খোলা বারান্দায় চেয়ারে এসে বসলাম। সাব্বির জানালেন, বানারীপাড়ার চাখারে আমাদের আদি বাড়ি। ওখানেই দাদার জš§।

জš§ ১৮৯২ সালেরর ২৩ জানুয়ারি। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের ভাগ্নে ছিলেন আমার দাদা। লঞ্চে যাচ্ছেন তা তো ওই লঞ্চ বানারীপাড়া হয়েই যাবেÑ এর পাশেই তো চাখার। লঞ্চে বসে না হয় দেখবেন বানারীপাড়া আর চাখার।

ওখানে দুপুরের খাওয়া সেরেই রিকশা ধরে চললাম হুলারহাটে। অগ্রদূত প¬াসে উঠলামÑ মিনিট দশেক পরে লঞ্চ ছেড়ে দিল। মনে মনে ভাবলাম, বাহ এবারের ভ্রমণটা তো বেশ ভালোই হল। ভান্ডারিয়া ভ্রমণে লঞ্চে কেবিন ভাড়া নেয়া হয়েছিল ৯০০ টাকা।

ফেরার পথে আবার ৯০০ টাকা। লঞ্চে খাওয়ায় খরচ (আসা-যাওয়ার পথে) ৪০০ টাকা। ভান্ডারিয়ায় হোটেলে থাকা-খাওয়া বাবদ অন্যান্য খরচ লাগল ৬০০ টাকা। যে কেউ ৩ হাজার টাকা নিয়ে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলায় বেড়াতে যেতে পারেন।

ভান্ডারিয়ায় গেলে খুঁজে পাবেন নদী, খাল, বিল, সবুজ প্রান্তর। দেখবেন নদী তীরে নারকেল-সুপারির বাগান।    শুনবেন কত না পাখির ডাক। সর্বত্রই   নির্জনতা। এই নির্জনতা আপনার মনেও রঙ ছড়িয়ে দেবে।

বাংলাদেশ সময় : ১৯১৯ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, কো-অর্ডিনেশন এডিটর     

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।