ঢাকা, সোমবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৯ মে ২০২৫, ২১ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অব্যক্ত জগদীশচন্দ্র বসু

স্বপ্নযাত্রা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০২, মার্চ ৫, ২০১৩
অব্যক্ত জগদীশচন্দ্র বসু

বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা অন্তত মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তারা সবাই জগদীশচন্দ্র বসুর নাম শুনেছেন। শুধু শুনেছেন বললে কম বলা হয়, ‘বিজ্ঞান’ বলতে বাঙালির মানসপটে যাঁর ছবি ভেসে ওঠে তিনি জগদীশচন্দ্র।



ভারতবর্ষে বিজ্ঞানী তিনি একাই নন, বাঙালিদের মধ্যেও আরো অনেক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী এসেছেন, তবু তাঁর নামটিই কেন সবার আগে মনে আসে? বিজ্ঞানী হিসেবে এরকম বিরল খ্যাতি লাভ করা, অন্তত বাঙালিদের মধ্যে, সহজ কথা নয় তো! এবং এ-ও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, তাঁর কাজের পরিধি ও গুরুত্ব সম্বন্ধে তেমন ধারণা না থাকলেও শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই ‘জানেন’ যে, জগদীশের প্রধান আবিষ্কার- ‘গাছেরও প্রাণ আছে’!

তাঁর কাজের পরিধি যে অনেক ব্যাপক ও গভীর সেকথা খুব বেশি মানুষ জানেন বলে মনে হয় না। না জানার কারণও পরিষ্কার। তাঁর বিজ্ঞান-জীবনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাজই এখন পর্যন্ত ব্যাখ্যাতীত এক রহস্যময়তায় ভরা, না বোঝার ফলে যা দূরবর্তী বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা প্রকাশিত বই ‘অব্যক্ত’ থেকেই দুটি অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া হলো।

গাছের কথা
গাছেরা কি কিছু বলে? অনেকে বলিবেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? গাছ কি কোনও দিন কথা কহিয়া থাকে? মানুষেই কি সব কথা ফুটিয়া বলে? আর যাহা ফুটিয়া বলে না, তাহা কি কথা নয়? আমাদের একটি খোকা আছে, সে সব কথা ফুটিয়া বলিতে পারে না; আবার ফুটিয়া যে দুই চারিটি কথা বলে, তাহাও এমন আধ-আধ ও ভাঙ্গা-ভাঙ্গা যে, অপরের সাধ্য নাই তাহার অর্থ বুঝিতে পারে। কিন্তু আমরা আমাদের খোকার সকল অর্থ বুঝিতে পারি। কেবল তাহা নয়। আমাদের খোকা অনেক কথা ফুটিয়া বলে না; চক্ষু, মুখ ও হাত নাড়া, মাথা নাড়া প্রভৃতির দ্বারা আকার ইঙ্গিতে অনেক কথা বলে, আমরা তাহাও বুঝিতে পারি, অন্যে বুঝিতে পারে না। একদিন পার্শ্বের বাড়ী হইতে একটি পায়রা উড়িয়া আসিয়া আমাদের বাড়ীতে বসিল; বসিয়া গলা ফুলাইয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল। পায়রার সঙ্গে খোকার নতুন পরিচয়; খোকা তাহার অনুকরণে ডাকিতে আরম্ভ করিল। পায়রা কি-রকমভাবে ডাকে? বলিলেই ডাকিয়া দেখায়; তদ্ভিন্ন সুখে, দুঃখে, চলিতে বসিতে, আপনার মনেও ডাকে। নূতন বিদ্যাটা শিখিয়া তাহার আনন্দের সীমা নাই।

একদিন বাড়ী আসিয়া দেখি, খোকার বড় জ্বর হইয়াছে; মাথার বেদনার চক্ষু মুদিয়া বিছানায় পড়িয়া আছে। যে দুরন্ত শিশু সমস্ত দিন বাড়ী অস্থির করিয়া তুলিত, সে আজ একবার চক্ষু খুলিয়া চাহিতেছে না। আমি তাহার বিছানার পাশে বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাখিলাম। আমার হাতের স্পর্শে খোকা আমাকে চিনিল এবং অতি কষ্টে চক্ষু খুলিয়া আমার দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিল। তারপর পায়রার ডাক ডাকিল। ঐ ডাকের ভিতর আমি অনেক কথা শুনিলাম। আমি বুঝিতে পারিলাম, খোকা বলিতেছে,  “খোকাকে দেখিতে আসিয়াছ? খোকা তোমাকে বড় ভালোবাসে। ” আরও অনেক কথা বুঝিলাম, যাহা আমিও কোনো কথার দ্বারা বুঝাইতে পারি না।
যদি বল, পায়রার ডাকের ভিতর এত কথা কি করিয়া শুনিলে? তাহার উত্তর এই- খোকাকে ভালবাসি বলিয়া। তোমরা দেখিয়াছ, ছেলের মুখ দেখিয়া মা বুঝিতে পারেন, ছেলে কি চায়। অনেক সময় কথারও আবশ্যক হয় না। ভালবাসি দেখিলেই অনেক গুণ দেখিতে পাওয়া যায়, অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়।

আগে যখন একা মাঠে কিংবা পাহাড়ে বেড়াতে যাইতাম তখন সব খালি-খালি লাগিত। তারপর গাছ, পাখী, কীট পতঙ্গদিগকে ভালবাসিতে শিখিয়াছি। সে অবধি তাদের অনেক কথা বুঝিতে পারি, আগে যারা পারিতাম না। এই যে গাছগুলি কোন কথা বলে না, ইহাদের যে আবার জীবন আছে, আমাদের মত আহার করে, দিন দিন বাড়ে, আগে এ সব কিছুই জানিতাম না; এখন বুঝিতে পারিতেছি। এখন ইহাদের মধ্যেও আমাদের মত অভাব, দুঃখ-কষ্ট দেখিতে পাই। জীবন-ধারণ করিবার জন্য ইহাদিগকেও সর্ব্বদা ব্যস্ত থাকিতে হয়। কষ্টে পড়িয়া ইহাদের মধ্যেও কেহ কেহ চুরি ডাকাতি করে। মানুষের মধ্যে যেরূপ সদগুণ আছে, ইহাদের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু দেখা যায়। বৃক্ষদের মধ্যে একে অন্যকে সাহায্য করিতে দেখা যায়, ইহাদের মধ্যে একের সহিত অপরের মধ্যে বন্ধুতা হয়। তারপর মানুষের জীবন রক্ষা করেন। সন্তানের জন্য নিজের জীবন-দান উদ্ভিদেও সচরাচর দেখা যায়। গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়া মাত্র। ক্রমে এ সব কথা তোমাদিগকে বলিব।

তোমরা শুষ্ক গাছের ডাল সকলেই দেখিয়াছ। মনে কর, কোন গাছের তলাতে বসিয়াছ। ঘন সবুজ পাতায় গাছটি ঢাকা, ছায়াতে তুমি বসিয়াছ। গাছের নীচের এক পার্শ্বে একখানি শুষ্ক ডাল পড়িয়া আছে। এক সময় এই ডালে কত পাতা ছিল, এখন সব শুকাইয়া গিয়াছে, আর ডালের গোড়ার উই ধরিয়াছে। আর কিছুকাল পরে ইহার চিহ্নও থাকিবে না। আচ্ছা, বল ত- এই গাছ আর এই মরা ডালে কি প্রভেদ? গাছটি বাড়িতেছে, আর মরা ডালটা ক্ষয় হইয়া যাইতেছে। একে জীবন আছে, আর অন্যটিতে জীবন নাই। যাহা জীবিত তাহা ক্রমশঃ বাড়িতে থাকে। জীবিতের আর একটি লক্ষণ এই যে তাহার গতি আছে, অর্থাৎ তাহারা নড়ে চড়ে। গাছের গতি হঠাৎ দেখা যায় না। লতা কেমন করিয়া ঘুরিয়া গাছকে জড়াইয়া ধরে, দেখিয়াছ? ...

তারহীন সংবাদ
অদৃশ্য আলোক ইট-পাটকেল, ঘর-বাড়ী ভেদ করিয়া অনায়াসেই চলিয়া যায়। সুতরাং ইহার সাহায্যে বিনা তারে সংবাদ প্রেরণ করা যাইতে পারে। ১৮৯৫ সালে কলিকাতা টাউনহলে এ সম্বন্ধে বিবিধ পরীক্ষা প্রদর্শন করিয়াছিলাম। বাঙ্গাল লেপটেন্যান্ট গর্ভনর স্যার উইলিয়াম মেকেঞ্জি উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুতের্ম্মি তাঁহার বিশাল দেহ এবং আরও দুইটি রুদ্ধ কক্ষ ভেদ করিয়া তৃতীয় কক্ষে নানাপ্রকার তোলপাড় করিয়াছিল। একটা লোহার গোলা নিক্ষেপ করিল, পিস্তল আওয়াজ করিল এবং বারুদস্তূপ উড়াইয়া দিল। ১৯০৭ সালে মার্কনী তারহীন সংবাদ প্রেরণ করিবার পেটেন্ট গ্রহণ করেন। তাঁহার অত্যদ্ভূত অধ্যবসায় ও বিজ্ঞান ব্যবহারিক উন্নতিসাধনে কৃতিত্বের দ্বারা পৃথিবীতে নূতন যুগ প্রবর্তিত হইয়াছে। পৃথিবীর ব্যবধানে একেবারে ঘুচিয়াছে। পূর্ব্বে দূর দেশে কেবল টেলিগ্রায়ের সংবাদ প্রেরিত হইত, এখন বিনা তারে সর্ব্বত্র সংবাদ পৌঁছিয়া থাকে।

কেবল তাহাই নহে। মনুষ্যের কণ্ঠস্বরও বিনা তারে আকাশ-তরঙ্গ সাহায্যে সুদূরে শ্রুত হইতেছে। সেই স্বর সকলে শুনিতে পায় না, শুনিতে হইলে কর্ণ আকাশের সুরের সহিত মিলাইয়া লইতে হয়। এইরূপে পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্য্যন্ত অহোরাত্রি কথাবার্ত্তা চলিতেছে। কান পাতিয়া তবে একবার শোন। “কোথা হইতে খবর পাঠাইতেছ? উত্তর - “সমুদ্র-গর্ভে, তিন শত হাত নীচে ডুবিয়া আছি। ” আর এ কি? একেবারে লক্ষ লক্ষ কামানের গর্জ্জন শোনা যাইতেছে, অগ্নুৎপাতে যেন মেদিনী বিদীর্ণ হইল। পরে জানিলাম মহাসাম্রাজ্য চূর্ণ হইয়াছে, কল্য হইতে পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হইবে। এই ভীষণ নিনাদের মধ্যেও মনুষ্য-কণ্ঠের কত মর্ম্মবেদনাধ্বনি, কত মিনতি, কত জিজ্ঞাসা ও কত রকমের উত্তর শোনা যায়। ইহার মধ্যে কে একজন অবুঝের মত বারবার একই নাম ধরিয়া ডাকিতেছে- “ কোথায় তুমি- কোথায় তুমি?” কোন উত্তর আসিল না- সে আর এই পৃথিবীতে নাই।
এইরূপ দূরদূরান্ত বাহিয়া আকাশের সুর ধ্বনিত হইতেছে। মনে কর, কোন অদৃশ্য আঙ্গুলি বৈদ্যুতিক অর্গ্যানের বিবিধ স্টপ আঘাত করিতেছে। বামদিকের স্টপে আঘাত করাতে এক সেকেন্ডে একটি স্পন্দন হইল। অমনি শূন্যমার্গে বিদ্যুতোর্ম্মি ধাবিত হইল। কি প্রকাণ্ড সেই সহস্র ক্রোশব্যাপী ঢেউ! উহা অনায়াসে হিমাচল উল্লঙ্ঘন করিয়া এক সেকেন্ডে পৃথিবী দশবার প্রদক্ষিণ করিল। এবার অদৃশ্য অঙ্গুলি দ্বিতীয় স্টপ আঘাত করিল। এইবার প্রতি সেকেন্ডে আকাশ দশবার স্পন্দিত হইল। এইরূপে আকাশের সুর ঊর্দ্ধ হইতে ঊর্দ্ধতরে উঠিবে; স্পন্দনসংখ্যা এক হইতে দশ, শত সহস্র, লক্ষ, কোটি গুণ বৃদ্ধি পাইবে। আকাশ-সাগরে নিমজ্জমান রহিয়া আমরা অগণিত ঊর্ম্মি দ্বারা আহত হইব, কিন্তু ইহাতেও কোন ইন্দ্রিয় জাগরিত হইবে না। আকাশ-স্পন্দন আরও ঊর্দ্ধে উঠুক তখন কিয়ৎক্ষণের জন্য তার অনুভূত হইবে। তাহার পর চক্ষু উত্তেজিত হইয়া রক্তিম, পীতাদি আলোক দেখিতে পাইবে। এই দৃশ্য আলোক এক সপ্তক গণ্ডীর মধ্যে আবন্ধ। সুর আরও উচ্চে উঠিলে দৃষ্টিশক্তি পুনরায় পরাস্ত হইবে। অনুভূতি শক্তি আর জাগিবে না, ক্ষণিক আলোকের পরেই অবেদ্য অন্ধকার।

তবে ত আমরা এই অসীমের মধ্যে একবারে দিশাহারা, কতটুকুই বা দেখিতে পাই? একান্তই অকিঞ্চিৎকর! অসীম জ্যোতির মধ্যে অন্ধবৎ ঘুরিতেছি এবং ভগ্ন দিক-শলাকা লইয়া পাহাড় লঙ্ঘন করিতে প্রয়াস পাইয়াছি। হে অনন্ত পথের যাত্রী, কি সম্বল তোমার?

সম্বল কিছুই নাই, আছে কেবল অন্ধ বিশ্বাস; যে বিশ্বাসবলে প্রবাল সমুদ্রগর্ভে দেহাস্থি দিয়া মহাদ্বীপ রচনা করিতেছে। জ্ঞান-সামরাজ্য এইরূপ অস্থিপাতে তিল তিল করিয়া বাড়িয়া উঠিতেছে। আঁধার লইয়া আরম্ভ, আঁধারেই শেষ, মাঝে দুই একটি ক্ষীণ আলো দেখা যাইতেছে। মানুষের অধ্যবসায় বলে ঘন কুয়াশা অপসারিত হইবে এবং একদিন বিশ্বজগৎ জ্যোতির্ম্ময় হইয়া উঠিবে।

সহায়ক বই:
অব্যক্ত, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
ভূমিকা: আহমাদ মোস্তফা কামাল

বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৩
সম্পাদনা: শেরিফ সায়ার, বিভাগীয় সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।