ট্রেনে উঠলেন এক নবদম্পতি। ট্রেনের জানালা খুলেই বধূটি দেখতে পেলেন তরতাজা আমলকি বিক্রি হচ্ছে।
এটি বেসরকারি একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের দৃশ্যায়ন। আমার আলোচনা কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে নয়, নারীর পক্ষে নয়; নয় পুরুষের পক্ষে। একজন মানুষ হিসেবে চোখে দেখে খারাপ লাগা একটি বিষয়ে। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে আমি শুধু আলোচনা করতে চাই বাঙালি নারীর চিরায়ত চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই বিজ্ঞাপনের কপিরাইটারের স্ক্রিপটা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা নিয়ে।
বিজ্ঞাপন চিত্রটি শেষ হওয়া মাত্র ড্রয়িং রুমে হাসির ঝড় ওঠে; ওঠে সমালোচনাও। কিন্তু কেন? আমরা যে বাংলার নারীকে চিনি, জানি সেই বাংলার নারী কি এমন? আমি মুষ্টিমেয়ের কথা বলছি না, অধিকাংশের কথা বলছি।
অম্বুজাসুন্দরী নামের এক একজন নারীর লেখা কবিতা উদ্ধৃত করে মূল আলোচনায় যাবো।
বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী,
ধীরতা নম্রতা মাখা, ঘোমটায় মুখ ঢাকা
রয়েছ উনান-ধারে চিরকাল ধরি,
বড় ভালবাসি আমি বঙ্গ-কুল-নারী।
নয়নে কজ্জল-দাগ অধরে তাম্বুলরাগ
ললাটে সিন্দুর-বিন্দু লক্ষ্মীর আসন......
বুক-ভরা স্নেহ-ধারা, পতি-প্রেমে মাতোয়ারা
স্থির সরসীর ন্যায় গম্ভীর সুস্থির।
কবি চিরকাল উনান ধারে থাকা নারীর হয়ে একটি চাপা প্রতিবাদ এ কবিতায় করেছেন। কিন্তু তিনিও নারীর রমণীয় স্বভাবের কথা স্বীকার করতে একবারও ভোলেননি। নারী আধুনিক হয়ে উঠুক সেটা আমিও চাই। কিন্তু নারীর একান্ত নিজস্ব রমণীয় স্বভাবগুলো বিসর্জন দিয়ে নয়।
আমাদের দেশের নারীবাদীরা মেরি ওলস্টোনক্রাফট, ভার্জিনিয়া উলফ, সিমোঁ দ্য বুভোয়ার, হেনরিক ইবসেন, বেগম রোকেয়া পাঠ করে তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নারীর অধিকার রক্ষায় আলোচনার টেবিল, মাঠ গরম করেন। বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে প্রদর্শনের জন্য সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেন। কিন্তু একটি বিজ্ঞাপনে যখন নারীর চরিত্রে কাণ্ডজ্ঞানহীনতা ও নির্বিবেক স্বার্থপরতা চাপিয়ে দিয়ে নারীকে হেয় করা হচ্ছে, ছোট করা হচ্ছে, এক অর্থে অপমান করা হচ্ছে, তখন কেন তারা চুপ করে বসে আছেন? আমাদের মা, বোনদের মধ্যে কি আমরা এই চরিত্র দেখি? পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব নিশ্চয় আমাদের সমাজে পড়েছে। কিন্তু নারীর এই রূপ আমরা আসলেই কি গড়পড়তা নারীদের মধ্যে দেখি? নিশ্চয় ‘না’ বলবেন।
বাংলার যে মা নিজের সন্তানের জন্য জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে ভয় পান না, যে স্ত্রী স্বামী ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মুখে খাবার তুলতে অপরাধবোধে ভোগেন, সেই নারীর কাছে স্বামীর চেয়ে এক প্যাকেট আমলকি এবং সবশেষে লবণ না আনার জন্য মুখ ঝামটা কি কোনোভাবেই কি শোভন?
স্বীকার করি আর নাই করি বাঙালি নারী অম্বুজাসুন্দরীর কবিতার মতো স্বভাবের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রাঙ্গদাকে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমীলাকে সমাজের চিরায়ত প্রথা ভেঙে নারীর ভিন্ন রূপ দেখিয়েছেন। চিত্রাঙ্গদা নিজের পরিচয় দিচ্ছে এভাবে:
চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই;
অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখো
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী
আমার পাইবে তবে পরিচয়। (চিত্রাঙ্গদা, ১২৯৮)
নারীর আধুনিকতার আলোচনায় বারবার উঠে আসা মধুসূদনের প্রমীলা রণসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে পতি মেঘনাদের জন্যই, নারীত্বকে বিসর্জন দিতে নয়। মধুসূদন নারীকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এসেছেন, রণসজ্জায় সজ্জিত করেছেন, কিন্তু নারীর স্বভাবকে বিসর্জন দেননি।
সাধারণ দর্শক হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে বিজ্ঞাপনে নারীর এই অবমূল্যায়ন মেনে নেওয়া কঠিন। এটা মেনে নিলে আধুনিকতার নামে আমাদের মা, বোনদের অপমানকে সহ্য করা হয়। এটাও নিশ্চয় একজন বাঙালির স্বভাব নয়।
সাময়িক মজা দিতে, কিংবা একটি মেসেজ দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে নারীকে এভাবে না উপস্থাপন করে অন্যভাবেও তো করা যায়, সে দৃষ্টান্ত এই প্রতিষ্ঠানেরই অন্য অনেক বিজ্ঞাপনে রয়েছে। সেগুলোর জনপ্রিয়তা নিশ্চয় কম নয়।
আরও একটি বিজ্ঞাপনের কথা নিশ্চয় দর্শকের মনে আছে। এটিও একই সিরিজের আগেরটি। আট বছর আগে এক দ্বীপে আটকে পড়েছিল সাইফুল। সেখানে যোগ হয় মুকিত নামে আরেক জেলে। অবশেষে ঘরে ফেরার পথ তৈরি করে তারা। সাইফুল মুকিতকে তার স্ত্রী সম্পর্কে বলেন দেখো, তোমার ভাবির ইমোশন, ভালোবাসা। তার ইমোশন দেখে তুমি আবার ইমোশনাল হয়ে পড়ো না। কিন্তু বাস্তবতা দেখা যায় ভিন্ন। সাইফুলের স্ত্রী তাকে আপ্যায়ন করলো ভিন্নভাবে। আট বছর পর স্বামীর বাড়ি ফিরে আসার কোনো কারণ না জেনে, সহানুভূতি প্রকাশ না করে ঝাঁঝালো ভাষায় মুখের ওপর বাজারের থলি ছুঁড়ে দিয়ে আপ্যায়ন করা কি বাঙালি মেয়েদের স্বভাব? প্রতেকের বাড়িতে মা, বোন আছে। একবার ভেবে দেখুন তো।
একজন মানুষ হিসেবে আনন্দ দেওয়ার নামে, পণ্যের প্রচারের জন্য মানুষকে ছোট করা নিশ্চয় শোভন নয়। বিজ্ঞপনী সংস্থাগুলোর ক্রিয়েটিভ ডিপার্টমেন্টে অনেক মেধাবী মানুষ কাজ করেন। তারা, আশা করি, বিকল্প পথ বেছে নেবেন। কাউকে ছোট করে নিজের প্রসারে সাময়িক আনন্দ হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু একবার ভাবুন। কাজটি আসলেই কি ঠিক?
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৩
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর/ email: eic@banglanews24.com