এম্ব্রয়ডারিতে নিঁখুত কাজ করা লাল ঘোমটা মাথার ওপর তোলা। দুই হাত একসঙ্গে বেঁধে পূণম চৌধুরী নিঃশ্বাস আটকে রেখে শুনছেন তার প্রেমিকের মুখে উচ্চারিত শব্দমালা- আমি এই বিয়ে কবুল করলাম।
ব্রহ্মাণ্ডে মানব-মানবীর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার ক্ষণটিই হচ্ছে বিয়ের সময়। কিন্তু সেই বিয়ে সম্পন্ন হলো ভিডিও চ্যাট প্রোগ্রাম স্কাইপের মাধ্যমে। বিয়ের পাত্র-পাত্রীর অবস্থান পৃথিবীর ঠিক দুই প্রান্তে। পূণম চৌধুরী ছিলেন নিউইয়র্কের কুইন্সে বাঙালি অধ্যুসিত জ্যকসনহাইটসের একটি মসজিদে। আর স্বামী তানভীর আহমেদ তখন বাংলাদেশে তার নিজ ঘরের লিভিং রুমে।
ইন্টারনেটের আশির্বাদে এমন বিয়ে আজকাল আকছারই হচ্ছে। পূণম ও তানভীরের মধ্যে সরাসরি দেখা হয়েছে মাত্র একবার তাও কয়েক বছর আগে। আর এরপর তাদের যোগাযোগ কেবলই ইন্টারনেটে। রোমান্টিকতার সনাতনি ধারাকে পেছনে ফেলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ পরে প্রেম-ভালোবাসা ম্যালাই হয়। আজকাল বিয়েও হচ্ছে। কম্পিউটার স্ক্রিনেই বলা হচ্ছে ‘কবুল’। আর তাতে বিয়ে সুসম্পন্ন হতেও কোনো বাধা থাকছে না।
ইংরেজিতে এই ধরনের বিয়েকে বলে প্রক্সি ম্যারিজ। এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া যাতে বর-কনের একজনের কিংবা দু’জনের অনুপস্থিতিতেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে। ফরাসী রাজা লুই ষোড়শ ও মেরি আন্তোনিতির বিয়েটাই এর সেরা উদাহরণ। এই বিয়েতে রাজা লুই ছিলেন অনুপস্থিত। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয় অস্ট্রিয়ায় আন্তোনিতির দেশে। পরে তাকে জাহাজে চাপতে হয় রাণীর বেশে ফ্রান্সের পথে। টেলিগ্রাফের মাধ্যমে প্রক্সি বিয়ের উদাহরণও পাওয়া যায় পুরোনোকালের নথিপত্রে।
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োজিত সেনারা মাঝে মধ্যে এমন বিয়ে করেন। তবে এমন বিয়ে ব্যবস্থার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার অভিবাসীদের মধ্যেই দেখা যায়। আর তা বাড়ছেও ক্রমবর্ধমান হারে। অভিবাসীরা তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজতে নিজ দেশকেই বেশি বেছে নেয়। আর বিয়ের জন্য দেশে যাওয়া-আসার খরচ বাঁচাতে ইন্টারনেটের স্কাইপে ভিডিও চ্যাট হচ্ছে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম।
তবে এ নিয়ে উদ্বেগও কম নয়। এর মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। আর এর মাধ্যমে নারীদের পাচার চক্রের হাতে ধরা পড়ার সুযোগ রয়েছে।
তবে এই পদ্ধতিতে বিয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার একটি লোভও কাজ করে। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এখনো বিষয়টি নিয়ে অতটা ওয়াকিবহাল নয় বলেই নিউইয়র্ক টাইমস তার একটি রিপোর্টে লিখেছে। তবে যাদের মাধ্যমে এমন বিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে তারা জানাচ্ছে ক্রমেই বাড়ছে এমন বিয়ের সংখ্যা।
পূণম চৌধুরীর বিয়ের কাজীর কথাই ধরা যাক। জ্যাকসন হাইটস কাজি অফিসের এই কাজি মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ূম বললেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যারা কাজিন ভাইবোনদের বিয়ে করে আনার কথা বলে আমি তাদের ফিরিয়ে দেই। কারণ তাদের উদ্দেশ্যই থাকে বিয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার সুযোগটি নেওয়া।
আর কুইন্সের কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট মাজেদা এ উদ্দিনের মতে, অনেকেরই মূল্য লক্ষ্য থাকে একটি গ্রিনকার্ডের দিকে, জীবনসঙ্গী পাওয়াটি প্রধান উদ্দেশ্য থাকে না। মাজেদা নিজেও মাঝে মধ্যে ঘটকের কাজ করেন। তিনি বললেন, এ কারণেই আমি প্রক্সিবিয়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কলেজের অধ্যাপক অ্যাডাম ক্যানডিউব প্রক্সিবিয়ে নিয়েই পড়াশুনা করেছেন। তার মতে, বিয়ের সনাতনি রীতিতে পাত্র-পাত্রীর একই স্থানে যাজকের সামনে উপস্থিত থাকার রীতির কারণটিই সম্ভবত তারা দুজন দুজনকে পছন্দ করেছেন তা নিশ্চিতভাবে জানা। কিন্তু বিশ্বের যে কোনো স্থানে থেকে বিয়ে করার এই ধরণটিতে কিছুটা ফাঁক-ফোঁকর থেকেই যায়।
পূণম চৌধুরী ও তানভীর আহমেদের বিয়ের আইনি রেজিস্টার হয়েছে বাংলাদেশে। কারণ নিউইয়র্কে এমন ব্যবস্থা আইনগতভাবে বৈধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে প্রক্সিবিয়ের অনুমতি আছে তবে সেক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর মধ্যে একজনকে অবশ্যই সামরিকবাহিনীতে থাকতে হবে। তবে বিদেশি বিয়ে করার সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের রয়েছে। এবং সে বিয়ে যদি বিদেশে আইনিভাবে রেজিস্টার্ড হয়, এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আইনভঙ্গ না হয় তাহলে তা বৈধ।
ইন্টারনেটে স্কাইপে প্রযুক্তি প্রক্সিবিয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রক্সি ম্যারিজ নাও নামের একটি কম্পানির অপারেশন ম্যানেজার জর্জ এন্ড্রুজ জানান, গত সাত বছর ধরে তার কম্পানিটি এই কাজ করছে। এই সময়ে বছরে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ব্যবসা বাড়ছে। প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৫০০ প্রক্সিবিয়ে সম্পন্ন হচ্ছে তাদের মাধ্যমে।
টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির এই অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে এর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে বললেন কুইন্সের জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম শামসি আলি। তিনি বলেন, স্কাইপে পদ্ধতিটি আরও সহজ। আজকাল গুগল হ্যাংআউটেরও ব্যবহার হচ্ছে।
তবে সনাতনী পদ্ধতিতেই যাদের বিশ্বাস তার এর ঘোর বিরোধী।
“আমার কাছে অবাক লাগে। বিয়ে মানেই দুটি মানুষের মিলন। এ পদ্ধতিতে তা নেই। বললেন নিউইয়র্কের ম্যানহাসেটের একটি ওয়েডিং কম্পানির মালিক অ্যাঞ্জিলা ট্রোইয়া। আমি মনে করি এর মাধ্যমে বিয়ে শব্দটির অর্থই পাল্টে যায়, বলেন ট্রোইয়া।
তবে ২১ বছরের পূণম চৌধুরী ও ৩১ বছরের তানভীর চৌধুরী বিয়েটি একটু অন্যরকমই ছিলো। কম্পিউটার স্ক্রিনেই তানভীরের মুখের কাছে পূণম তুলে ধরেন কেক। আর পূণমকে বেশ প্রফুল্লই লাগছিলো। তিনিই জানান, অনেক আগে যখন ইন্টারনেট ছিলো না তখন তার ফুফুর বিয়েটিও ঠিক একইভাবে হয়েছে। তা ছিলো স্রেফ টেলিফোনে।
ওদিকে ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছিলো সহাস্য তানভীর আহমেদকে। “পূণমই আমার বৈধ স্ত্রী” বললেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ২০৪১ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৩
এমএমকে