মহাভারতের কোনও কাহিনী নয় এটা, যেখানে ঘটনাচক্রে মাতৃ-আদেশ পালন করতে গিয়ে পাঁচ ভাই দ্রৌপদী নামের একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে। একে বলা যায় মহাভারতের ঘটনার আধুনিক এবং বাস্তব এক রূপ।
সাম্প্রতিক সময়ে পাঞ্জাবে নারী-পুরুষের আনুপাতিক হারের একটি হিসাব হচ্ছে ৭৯৩ জন নারীর বিপরীতে ১০০০ পুরুষ। এ অবস্থায় পুরুষান্তরে জমির টুকরো থেকে টুকরো হয়ে যাওয়া রোধে গড়ে প্রতিটি পরিবারের অর্ধ-ডজন ভাই মিলে বিয়ে করছে একজন করে নারীকে। সরকারি সূত্রগুলোর দাবি অবশ্য ভিন্ন। তারা বলছে, বিয়ে করার মতো শিখ নারীর সংখ্যা বর্তমান পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলে আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার ফলেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এ পরিস্থিতি ঠেক দিতে আজকাল ওইসব এলাকার অনেকেই পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে বিয়ে করে ঘরে বউ তুললেও গ্রামের ধর্মগুরু ও সমাজপতিরা তাতে বাধ সাধছেন। নিজেদের সমাজ-সংস্কৃতির বাইরের মেয়েদের স্ত্রী করে আনার ফলে তাদের গর্ভে যেসব সন্তানের জন্ম হবে তারা সত্যিকারের পাঞ্জাবিদের চেয়ে হীনতর হবে বলে তারা মনে করেন।
অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে একজনের বিয়ে করা বউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর অন্য ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং ন্যাশনাল কমিশন ফর ওমেনের নজরদারিতেও এসেছে বিষয়টি। তারাও মনে করছে এসব অঞ্চলের নারীরা মোটেই স্বেচ্ছায় মনোদৈহিক এ দুর্ভোগ মেনে নিচ্ছেন না, প্রবল সামাজিক চাপ আর পারিবারিক দারিদ্র্যের অলঙ্ঘনীয় বাধ্যবাধকতাই তাদের বিনাবাক্যে এই প্রথা মেনে নিতে বাধ্য করছে। এর বিপরীতে সরকারি নথিপত্রে ‘বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া’ পুরুষের সংখ্যাটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পাঞ্জাবের গ্রামীণ জনপদ বাথিন্দা, মনসা মুকটসার, সাংগরুর, ফরিদকোটসহ আশপাশের এলাকায় পরিস্থিতি রীতিমতো আশঙ্কাজনক। তবে সরকারি এবং এক অর্থে সামাজিক হিসেবে পুরুষদের ওই বিশাল সংখ্যা অবিবাহিত থাকলেও সোজা বাংলায় যাকে বলে নারীসঙ্গ বা দাম্পত্য জীবনের স্বাদ থেকে এরা মোটেই বঞ্চিত নয়। খাতা-কলমে অবিবাহিত এসব পুরুষ প্রত্যেকে নিজ পরিবারে কোনও এক ভাইয়ের স্ত্রীকে ভাগাভাগি করছেন।
পাঞ্জাবের লুধিয়ানা ও জলন্দরের পল্লী অঞ্চলে চাষীদের মধ্যে দুটি শ্রেণী রয়েছে। একটি শ্রেণী হচ্ছে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক। তাদের রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক অফিসসহ বিশাল সব ফার্মহাউস বা কৃষিখামার, চলাচলের জন্য আছে ইম্পোর্টেড বিএমডব্লিউ, লেক্সাসসহ দামি গাড়ি। তাদের লাইফস্টাইলে পাঞ্জাবের সনাতনি ঐতিহ্যের ওপরে রয়েছে পুরু ওয়স্টার্ন সংস্কৃতির প্রলেপ। ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতি-রেওয়াজ আর বংশীয় বা গোত্রগত কৌলীণ্য বজায় রাখার স্বার্থে দরকারি আচার-অনুষ্ঠান আর জীবনাচারে তাদের মোটেই কোনও জটিলতায় পড়তে হয় না। আর অন্য শ্রেণীটি হচ্ছে আমাদের গ্রামাঞ্চলের মঙ্গাতাড়িত কৃষকদের মতো। এদের কারো কারো অল্প পরিমাণে জমি থাকলেও অধিকাংশই ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিক বা দিনমজুর প্রকৃতির লোক। এরা তাই থেকে যাওয়া যৎসামান্য ভূ-সম্পত্তিটুকুর খ- খ- হওয়া ঠেকাতে পাণ্ডব-দ্রৌপদী তত্ত্বের অনুশীলনে বাধ্য হয়ে পড়েছেন। আর যাদের সামান্য জমিটুকুও নেই তাদের জন্য বিষয়টা আরও বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে।
চলমান এই প্রক্রিয়ার তাৎক্ষণিক সুফল হচ্ছে, প্রচলিত সামাজিক বিধি-বিধানের বাইরে এটা তাদের এক ধরনের অদ্ভুত সম্পর্কের সূত্রতায় একতাবদ্ধ করে রেখেছে। পারিবারিক জীবনের অনেক দায়-দায়িত্বকে তারা যূথবদ্ধ হয়ে মোকাবিলা করছে। বিষয়টা অনেকটাই যেন ‘দশের লাঠি একের বোঝা’র মতো। এ ধরনের পরিবারগুলোতে সবার সম্মতি আর সহযোগিতায় বড়ভাইটি পরিবারের একক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে থাকে। বিষয়টা অনেকটাই যেন যাযাবরদের সর্দারপ্রথার ুদ্র সংস্করণ। অন্যদিকে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সংকট এবং নারী জনসংখ্যার সংকট মোকাবিলার এ অদ্ভুত পন্থায় বলি হওয়া নারীদের ব্যাপারে ভাবার ফুরসত কেউ খুব একটা পায় না বলেই মনে হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে পরিবারে প্রথম যে ভাইটা বিয়ে করে (সাধারণত বড় ভাই) তার স্ত্রীই স্বামীর অন্য ভাইদের দৈনন্দিন যাবতীয় প্রয়োজনের দেখভাল করেন। তাদের খাওয়া-দাওয়া, নাওয়া-গোসল, কাপড়-চোপড়, গরু-লাঙ্গল দেখা থেকে শুরু করে পালাক্রমে তাদের শয্যাসঙ্গীও হতে হয় তাকেই। কিছু কিছু ঘটনায় দেখা গেছে সর্বোচ্চ আট সহোদরের ‘স্ত্রী’ হতে হচ্ছে একজন মাত্র নারীকে। এ ব্যাপারে ন্যাশনাল কমিশন ফর ওমেনের চেয়ারম্যান ড. গিরিজা ব্যাস বলেন, ‘এ ধরনের একজন নারীর কয়েক গণ্ডা বাচ্চা-কাচ্চা থাকে, যাদের কারোই পিতৃ-পরিচয় নির্ধারিত নয়। ’ অর্থাৎ স্ত্রীটির আইনসিদ্ধ স্বামী বা তার কোন ভাইটি ওই সন্তানের প্রকৃত জন্মদাতা তা অজ্ঞাত থেকে যায়। এর আরেক অর্থ প্রতিটি সন্তানেরই কমন বাবা হচ্ছেন পাঁচ-ছয়-সাত বা আটজন সহোদর ভাই।
নারী নেত্রী গিরিজা ব্যাস আরও বলেন, ‘তবে ভাইয়েরা প্রত্যেকেই সন্তানদের নিজের সন্তান হিসেবেই দেখে, যতœ-আত্তি করে। কিন্তু এই অভিনব সামাজিক প্রথার বলি ওইসব নারীরা যে নিদারুণ মানসিক ও শারীরিক যাতনা ভোগ করে চলেছেন তা ভাবতেও আমরা শিউরে উঠি! আধুনিক কালে এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমাদের পক্ষে বিনাবাক্যে মেনে নেওয়াও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সমাজ জীবনে এহেন অস্বাভাবিক আচারকে কোনও মতেই সমর্থন করি না। ’
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে একজন নারীর একসঙ্গে জনা-আষ্টেক সহোদরের স্ত্রী হওয়ার এই অমানবিক ও অচিন্ত্যনীয় চল থামাতে আইন তেমন কিছু একটা করতেও পারছে না। কারণ ওইসব ‘বিয়ে’ কখনোই প্রচলিত ধর্মীয় বা সামাজিক বিধি-বিধান মেনে হয় না। তাই এ সংক্রান্ত কোনও প্রমাণপত্র বা সাক্ষী-সাবুদ একেবারেই পাওয়া যায় না। আর তাই হিন্দু বিবাহ আইন বা ভারতীয় দণ্ডবিধির কোনও ধারায়ই একে শাস্তিযোগ্য বা অপরাধ হিসেবে প্রমাণ করা যাচ্ছে না। কর্মকর্তাদের মতে, এ ধরনের কোনও প্রথা-প্রচলন, সমাজে যার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তা ঠেকানো কঠিন। কোনও নারী এর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হয়েছে এমন ঘটনাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অপরদিকে এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এসব গ্রামে সমাজপতি আর পরিবারগুলোর মাঝে রয়েছে মজবুত এক সমঝোতা।
সূত্র: খালিজ টাইম্স, শিখ ফিলসফি ডট নেট
ahsan.akraza@gmail.com
বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ২০২৮, জুলাই ২৬, ২০১০