ঢাকা: মেলা বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ সংস্কৃতি এসেছে মূলত গ্রাম থেকেই।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, তাই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে মেলার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আগের দিনে মানুষ চাঁদ ও সূর্যকে বুড়ো আর বুড়ি বলে ডাকত। সেখান থেকে বুড়োবুড়ির মেলার চল শুরু হয়। পরবর্তীতে শুরু হয় সূর্যমেলা, সূর্যঠাকুরের মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, চড়কমেলা ও শিবগাজনের মেলার প্রচলন।
গ্রামগঞ্জে একসময় বরুণ-বারুণীর মেলা বসতো। বরুণ বা বারুণী হলো মেঘের দেবতা। এ মেলা বান্নি মেলা নামেও পরিচিত ছিল। বাংলাদেশের গ্রাম-শহর মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মেলা বসে। ব্রত, পালা, পার্বণ, ঐতিহ্য, ঋতু, সাধু-সন্তের ওরশ, বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মরণ, জাতীয় দিবস, বাণিজ্য, ধর্মীয়সহ নানা উপলক্ষে বসে এসব মেলা।
মেলায় স্থানীয় ফসল, কুটিরশিল্প, নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ও নানান গৃহসামগ্রীর বেচাকেনা হয়। আগে মেলায় শারীরিক কসরত প্রদর্শনী, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আসর বসতো। যদিও সময়ের পরিক্রমায় মেলার আঙ্গিকে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেলা বসে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান উপলক্ষে। যেমন- মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও আদিবাসীরা নিজেদের বিভিন্ন কৃত্যানুষ্ঠান উপলক্ষে মেলার আয়োজন করে।
সনাতন ধর্মে দুর্গা, শিব, কালীপূজা, রথযাত্রা, দোলযাত্রা ও জন্মাষ্টমী উপলক্ষে বসে বাহারি মেলা। কেবল রথযাত্রা উপলক্ষেই মেলা বসে ৬২টি’রও বেশি। শারদীয় দুর্গা উৎসবে বসে ৭২টি মেলা। এছাড়া চৈত্র, বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য পূর্ণিমাতেও মেলার আয়োজন করা হয়।
অন্যদিকে, মুসলিমদের বছরে দুই ঈদ উপলক্ষে বসে প্রায় ১৫ থেকে ১৬টি ঈদমেলা। এগুলো ছাড়াও রয়েছে মহররমের বর্ণাঢ্য মেলা। এদিন কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। এছাড়াও স্থানভেদে বসে জারি গানের আসর।
ঊনিশ শতকের শেষের দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির ঈদগাহে নামাজের পর মেলা বসতো। বিশ শতকের শুরু থেকেই চকবাজার আর রমনা মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়। পুরান ঢাকার হোসনী দালান আর আজিমপুরের মহররমের মেলার ঐতিহ্যও দীর্ঘসময়ের।
বৌদ্ধরা নিজেদের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে মেলার আয়োজন করে। বিশেষ করে বৌদ্ধ পূর্ণিমায় থাকে তাদের বিশেষ আয়োজন। চট্টগ্রামের বিজুড়ি গ্রামে বসে আশ্বিনী পূর্ণিমার মেলা। আর মাঘী পূর্ণিমায় মেলা জমে কুমিল্লাতে।
তবে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা কেবল বড়দিনেই মেলার আয়োজন করে। তাদের সবচেয়ে প্রাচীন মেলা বসে গোপালগঞ্জের কালীগ্রামে। এছাড়াও গাজীপুরের কালীগঞ্জে মেলা বসে প্রতিবছরই।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ও রাজশাহীতে বসবাসরত আদিবাসীরা প্রতিবছর বিজু, বৈসু ও সাংগ্রাই উৎসবে মেলার আয়োজন করে। তবে তাদের বেশিরভাগ মেলা কৃষি ও চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত।
এবার আসি দেশজ ঋতুভিত্তিক মেলার প্রসঙ্গে। চৈত্র সংক্রান্তি, বৈশাখী ও বসন্ত মেলা একেবারেই ঋতুভিত্তিক। বাংলা নববর্ষ বরণের চলও বেশ প্রাচীন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, লোক ও কারু মেলার আয়োজনও করা হয়।
সাধু-সন্তদের ওরশ উপলক্ষে অসংখ্য মেলা রয়েছে। এসব মেলার মধ্যে লালন ফকিরের দোল পূর্ণিমা, গোপালগঞ্জের হরিঠাকুর, সানাল শাহ ফকির, গুড়াই শাহ সুলতান, চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরী, নরসিংদীর বাউল ঠাকুর ও ফরিদপুরের সুরেশ্বরের মেলা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া বরণীয় ব্যক্তিদের স্মরণে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন, সুনামগঞ্জের হাসন, শিলাইদহে রবীন্দ্র, দরিরামপুরে নজরুল, অম্বিকাপুরে জসীম, সাগরদাঁড়ির মধুমেলাও বেশ জনপ্রিয়। এসব প্রসিদ্ধ মেলা ছাড়াও সম্প্রতি দেশের আধুনিক সংস্কৃতিতে যোগ হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্য, শিল্প, কুটির ও বস্ত্রমেলা। যা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০১৫
এসএস