ঢাকা: বয়স মাত্র ৯। এরই মধ্যে সাবাড় করেছে চার চারজন রক্তমাংসের মানুষ।
বলছি রাজস্থানের ৠানথামবোর টাইগার রিজার্ভে থাকা নয় বছর বয়সী পুরষ বাঘ টি-টোয়েন্টিফোরের কথা। কিন্তু পরিচিতি তার ‘উস্তাদ’ নামে। নামটি যথার্থ স্বার্থক। ভারতের মানুষকে তার ‘ব্যক্তিত্ব’ দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করতে সক্ষম হয়েছে সে। নাড়িয়ে দিয়েছে বিবিসি, ডেইলি মেইল, আল জাজিরার মতো সংবাদমাধ্যমকেও। তাকে তো লোকে উস্তাদ বলবেই!
সবশেষ মে মাসের ৮ তারিখে এ রিজার্ভ ফরেস্টের পাহারাদার রামপাল সাইনিকে হত্যার অভিযোগ তার দিকে। এর আগে ২০১২ সালে আরও একজন পাহারাদারকে হত্যা করে উস্তাদ। তালিকায় ছিলো আরও দুজন স্থানীয় ব্যক্তি, যারা উস্তাদের ‘রাজ্যে’ পা রেখেছিলেন।
কিন্তু উস্তাদকে নিয়ে বিতর্ক এখন সুতীক্ষ্ণ। জীববিজ্ঞানী এবং পরিবেশিবাদী সমালোচকরা বিভক্ত দুই ভাগে। কারও মত উস্তাদ সবগুলো নয়, একটি মৃত্যুর জন্য দায়ী। কারও মতে সবগুলোর জন্য। কিন্তু বন বিভাগ দেরি না করে রামপালের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে উস্তাদকে সরিয়ে নিয়ে যায় ৪শ কিলোমিটার দূরে উদয়পুরে। কারণ এ মৃত্যুর পর স্থানীয়দের মধ্যেও ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু উস্তাদের পক্ষের ক্ষুব্ধ লোকের সংখ্যা কম নয়। কারণ উস্তাদ এই রিজার্ভ ফরেস্টের সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ বাঘ, যে তার ঝকঝকে চেহারা দিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করতো। এজন্য তার ভক্ত সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছিলো। তাই গত এক সপ্তাহ ধরে উস্তাদকে তার জন্মস্থলে ফিরিয়ে আনার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে বিশেষ প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সবার দাবি একটাই। ‘উস্তাদকে ফিরিয়ে আনা হোক’।
তবে আরেকটি গ্রুপ কিন্তু তাকে সরানোর জন্য সরব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তর্ক-বিতর্ক গড়িয়েছে আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা পর্যন্তও। যারা তাকে কখনও দেখেনি, শুধু পড়েছে বা শুনেছে তারাও এসে দাঁড়িয়েছে উস্তাদের পাশে। খাঁচা থেকে মুক্ত দেখতে চান সবাই উস্তাদকে।
সবশেষ পাঁচ বছর তার বিরুদ্ধে এসব হত্যার অভিযোগ উঠেছে। কারণ মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটেছে সব তার সীমানার মধ্যে। অন্য কথায়, সে তার সীমানার বাইরে কাউকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয় না। প্রথম দুটি দেহাবশেষ পাওয়া যায় আংশিক খাওয়া অবস্থায়।
ভারতের ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটির (এসটিআরসিএ) নিয়ম অনুযায়ী, এটা মানুষখেকো বাঘের আচরণ নয়। তাছাড়া তার বসবাস সীমানার পাশ দিয়েই প্রতিদিন প্রায় হাজার পর্যটক ঘোরাফেরা করে। কিন্তু কারও উপর তো আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করেনি কখনও।
রাজস্থানের সাবেক পরিবেশমন্ত্রী বিনা কাক উস্তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন কঠিনচিত্তে। এমনকি তিনি একটি ছবিও পোস্ট করেছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে, যে পথে উস্তাদ ঘোরাফেরা করছে ঠিক সেই পথ দিয়ে তার কাছেই গ্রামের নারীরা পানির কলসি মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি এ প্রশ্নও রেখেছেন, এটা কি কোনো মানুষখেকো বাঘের চিত্র?
কোনো কোনো জীববিজ্ঞানীর মতে, স্থানীয়দের সঙ্গে উস্তাদের একধরনের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। আবার কারও মতে তার মতো বিপজ্জনক বাঘ আগে দেখেননি। রাজস্থানের বর্তমান বনমন্ত্রী রাজ কুমার রিনওয়া কেন উস্তাদকে সরানো হলো সে বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি এসটিআরসিএ প্রধান বিষেণ সিং ভোনালও একই প্রশ্ন রেখেছেন।
উস্তাদ এ রিজার্ভ ফরেস্টের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রেখে চলেছিলো। সে কখনো পর্যটক বহনকারী গাড়ি বা পর্যটকদের জন্য হুমকি ছিলো না বলে মত অধিকাংশ মানুষের। বন বিভাগ বলছে, উস্তাদের আচরণে পরিবর্তন ও ক্রমে বিপজ্জনক হয়ে ওঠার অকাট্য প্রমাণ তাদের কাছে আছে।
কর্তৃপক্ষ অকাট্য প্রমাণের কথা বললেও সমালোচকরা বলছেন, ২৭ বছর ধরে রামপাল বাঘদের দেখাশোনা করে আসছিলো। পাশের গনেশ মন্দিরের পাশের মানুষবাহী একটি চৌকিতে সে থাকতো। কিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক যে বাঘের সঙ্গে থেকেও তার বাঘের সঙ্গে কখন কেমন আচরণ করতে হবে সেটি না বুঝতে পারা।
স্থানীয়দের সঙ্গে এই রিজার্ভ ফরেস্টের বাঘেদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়। তারা চলছেও। এটা যদি তারা না করে তাহলে বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকবে।
রামপালের মৃত্যুর পর এই প্রথম পাহারাদাররা এলাকা ভাগ করে পাহারা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এবং দাবি জানিয়েছে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু এটাও জানা থাকা প্রয়োজন, বাঘ, যার নাম উস্তাদ সে বরাবরই কোষ্ঠ্যকাঠিন্যে ভুগেছে। এটা তার জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু বারবারই বন বিভাগের হস্তক্ষেপে সে রক্ষা পেয়েছে।
বর্তমানে ৠানতামবোরে ২১টি মেয়ে ও ২২টি পুরুষ বাঘ রয়েছে। বাচ্চা রয়েছে ১৫টি।
বৃহস্পিতিবার (২৮ মে) উস্তাদ তার জন্মভূমিতে ফিরবে কি ফিরবে না এনিয়ে রাজস্থান হাইকোর্টে শুনানি রয়েছে। মানুষ নানান প্রশ্ন তুলছে, জোর গলায় কথা বলছে, কিন্তু এটাও ঠিক বাঘেদের ভালোবাসার মানুষও রয়েছে।
ভারতের মানুষকে নয় বছর বয়সী উস্তাদ তার কেরামতিতে ঠিকই বিভক্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত কোন পক্ষ জয়ী হয় এখন সেটিই দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ সময়: ০২১০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৫
এএ