নাটোর থেকে ফিরে: শ্বেত পাথরের নারীরা সবটুকু সৌন্দর্য উজার করে দিয়েছে ইতালিয়ান গার্ডেনে। এই নারীদের প্রতিকৃতি ইতালিয়ান ভাবধারারই প্রকাশ।
বাগানটি যে প্রেম আর প্রণয়ের বার্তা বহন করে, তা ভাস্কর্যগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। চোখ ফেরানো যায় না শ্বেত পাথরে খোদাই করা নারীদের সৌন্দর্যে থেকে। দেখা মেলে লাইলী-মজনু বৃক্ষের। রয়েছে স্বর্গের গাছ ‘পারিজাত’। আর শিমুল-বকুলসহ আরও কত ফুল, তার সবের নামও জানা নেই।
এই বাগানের আসবাবপত্র রাজা দয়ারাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনিয়েছিলেন। ভাস্কর্যগুলো আনা হয়েছিল ইতালি থেকে। বাগানের পাশে পুকুর পাড়ে ছিপ হাতে মাছ ধরায় ব্যস্ত কৃষ্ণবর্ণ নারী। কালো রঙের মার্বেল পাথরের নারী ভাস্কর্যটি নজর কাড়ে। ধারালো নাক আর টানা চোখের ভাস্কর্যটি অবহেলায় অযত্নে হারিয়ে ফেলেছে নিজের আঙ্গুল। শরীরের ওপর ধুলাবালি আর ময়লার আস্তরণ।
উত্তরা গণভবন, দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি প্রাচীন স্থাপত্যকলার দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন। প্রায় ৩০০ বছর পুরাতন প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী এই প্রাসাদ। রাজবাড়ির সামনে সুদৃশ্য বিশাল এক সিংহ দুয়ার বা ফটক। সেই ফটকের ওপরে রয়েছে এক প্রকাণ্ড ঘড়ি যা রাজবাড়ির ভেতরে এবং বাইরে দুই দিক থেকেই দৃশ্যমান।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নাটোর রাজ্যের দেওয়ান দয়ারাম রায়। তিনি ১৭০৬ সালে কর্ম দক্ষতার উপহার হিসেবে বাস করার জন্য এই জমি পেয়েছিলেন। ১৭৩৪ সালে তার ওপরেই স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন এই দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
নাটোরের মূল শহর থেকে প্রায় দুই মাইল উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে দিঘাপতিয়া ইউনিয়নে এই রাজপ্রাসাদটি। পরে রাজা প্রমদা নাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশি মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির ওপর এই রাজবাড়িটি পুনর্র্নিমাণ করেন।
প্রাসাদের প্রবেশ মুখেই রয়েছে দুটি কামান। এরপর বাম পাশে গোল করে বাঁধানো পুকুর ঘাট পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে আরও কামান। বোঝা যায়, এই দিঘাপতিয়া সামরিক শক্তিতে খাটো ছিল না।
এরপর বিশাল রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তার স্মৃতিচারণ প্রতীক। ভবনের ওপরে চাঁদতারা গম্বুজ। প্রসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবন ছাড়াও রয়েছে আরও দুইটি ভবন। তবে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ নেই।
দ্বায়িত্বরত আনসারকে জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল পেছনের ইতালিয়ান গার্ডেনে যেতে হলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। সেখানে অনেক দামি ভাস্কর্য রয়েছে, নিরাপত্তার বিষয়। ভড়কে গেলাম, তবে কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম এটা সিন্ডিকেটের অংশ। ২০ টাকা হাতে দিলেই চলে যাওয়া যাবে পেছনের অংশে।
ছোট দরজা দিয়ে ইতালিয়ান গার্ডেনে ঢুকতেই শুভ্র নারী দেহের ভার্স্কয চোখে পড়ে। অপার সৌন্দর্যের পানে গেলেই মন খারাপ হয়ে আসে। সবার প্রথমেই ফ্লাওয়ার নামে একটি নারী ভাস্কর্য। যার পায়ের কাছে বায়না ধরে আছে ছোট্ট শিশুটি। ইতালিয়ান এই নারীর অবয়বকে এখানে সর্বোর্চ্চ অক্ষত ভাস্কর্য বলা যায়। যার হাত-পা ঠিক রয়েছে। এই মায়ের সৌন্দর্যকে মলিন করে রেখেছে ময়লার আস্তরণ।
বাগানের বামেই যে অপ্সরার হাত ভেঙ্গে রয়েছে, তা দেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত হতে হয়। সৌন্দর্যের অবহেলা স্পষ্ট। এই ভাস্কর্যের নাম পাহাড়িকন্যা। এর হাতের কবজিটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা ছিল।
পোষা প্রাণীটিকে শান্ত করতে চেষ্টা করছেন এক রমণী। আর প্রাণীটিরও সে কি আহ্লাদি ভাব। এখানেও ভাঙ্গা কব্জি আর অন্য হাতের ভাঙ্গা আঙ্গুলে রয়েছে অবহেলার ছাপ। শুধু অবহেলা নয়, এসব ভাস্কর্যকে ভেঙ্গে চুরিও করা হয়েছিল।
ভেজা শরীরের শ্বেত পাথরের রমণী তার চুল ঝাড়ছে। ফিনফিনে কাপড় বাঁধতে পারেনি তার শরীরের সুর। দ্বায়িত্বশীলদের অবহেলা আর জমে থাকা ধুলাও তার সৌন্দর্যকে হার মানাতে পারেনি।
ইতালিয়ান বাগানের মাঝখানে রয়েছে একটি ফোয়ারা। দুটি শিশুর উচ্ছ্বাসের মাঝ দিয়ে বেরিয়ে আসে পানির ছটা। এই বাগানের বেঞ্চগুলো কলকাতা থেকে আনা হয়েছিল। এখানেই রয়েছে রানীর টি-হাউজ। কিছুটা তৎকালীন পাশ্চাত্য ঢংয়ের বাড়ি। সরু বারান্দা দিয়ে হয়তো দাস-দাসী নিয়ে হেঁটে যেতেন। এর সামনে পুকুর ঘাটের উপর বড় করে বাঁধানো বারান্দা।
এই রাজবাড়িতে এক সময় শোনা যেত নিক্কন। আর সেই সঙ্গে মধুর কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা। ছিল পাইক-পেয়াদা-মালীদের ব্যাস্ততা, রাজ-রাজন্যবর্গের হাঁটাচলা, সভা। এখন শুধুই কালের সাক্ষী হয়ে আছে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি।
উত্তরা গণভবন চত্বরে গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাচারিপুকুর, কালীপুকুর, কেষ্টজির পুকুর নামে ছয়টি পুকুর রয়েছে। এছাড়া গণভবনের ভেতরের চারপাশে সুপ্রশস্ত পরিখা রয়েছে। প্রতিটি পুকুর পরিখায় সানবাঁধানো একাধিক ঘাট আছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায় দেশত্যাগ করে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজ প্রাসাদটির রক্ষণা-বেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। সেসময় থেকে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকে।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করে এবং ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই গভর্নর হাউসে রূপান্তর করা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা দেন। তবে ১৯৪৭ সালের পর অবশ্য এ ভবনে আর কেউ বসবাস করেন নি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০১৬
এমএন/এটি