ঢাকা, রবিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

ছোট ছোট চাহনি বলে দেয় না বলা কথা..

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৬
ছোট ছোট চাহনি বলে দেয় না বলা কথা.. ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: বাঁশের চটি আর মোটা প্লাস্টিকের ছোট ছোট খুঁপড়ি ঘর। পরিবারের প্রয়োজন মতেই প্রতিটি ঘরের ব্যাসার্ধ।

পাশেই রান্নার চুলা, মাটি খুঁড়ে তৈরি টয়লেট আর ছোট-ছোট খাল-বিল থেকে সংগৃহীত কম স্বচ্ছ পানির সংরক্ষণ। এসব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে খুলনা-মংলা মহাসড়কের পাশে কাটাখালির বেদেপল্লী।

ঘিঞ্জি ঘরগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বেদে সম্প্রদায় প্রায় দুই যুগ ধরে বসবাস করছে। এভাবে বসবাস করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই তাদের। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা।

খেলাধুলার জন্য তারা বেছে নেয় মহাসড়ক বা তার পাশের জায়গা। খেলায় মগ্ন থাকা অবস্থায় যে কোনো সময়ই দুর্ঘটনা শিকার হতে পারে বেদেপল্লীর এসব শিশু।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুয়াশা ভেজা ভোরে পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিরা বেরিয়ে গেছেন জীবিকার সন্ধানে। আর এই সুযোগে পল্লীজুড়ে ছোট শিশুরা পুরোদমে ব্যস্ত খেলাধুলা নিয়ে। আবার কেউ কেউ স্কুল থেকে নতুন বই পেয়ে ব্যস্ত সেই বই পড়তে।

জীর্ণ-শীর্ণ শরীরের এসব শিশুদের একাকিত্ব জীবন আর পেটে ক্ষুধা। সেই অনুভূতি কেমন, যন্ত্রণা কেমন তাদের ছোট ছোট চোখের চাহনি বলে দেয় না বলা অনেক কথা..।

সব কিছু ছাপিয়ে শিশুদের প্রাণখোলা হাসি জানান দেয় নতুন স্বপ্নের, নতুন প্রত্যাশার। বেদে নারী শিশু কাবারুলের কথায় সেটাই জানা যায়। সে লখপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। লেখাপড়া শিখে সে ডাক্তার হতে চায়।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিথি জানায়, মা-বাবা সারাদিন বাইরে থাকে। সে কারণে তাকে ঘরের কাজ করতে হয়। দূরের ভালো স্কুলে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই পাশের কাটাখালি স্কুলে পড়ে। বড় হয়ে সে স্কুলের ম্যাডাম হবে।

মাসুমা নামে এক বেদে নারী জানান, বেদে নারীরা হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে ও ওষুধ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। তাছাড়া দাঁতের পোকা তোলা, সিঙ্গা ফুঁকা, শরীরে উল্কি এঁকেও আয় করে তারা।

তিনি জানান, বন-জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড় থেকে পুরুষ বেদেরা সাপ ধরে নিয়ে আসে। বেদেনীরাও সাপ ধরতে পারে। ঢোঁরা সাপ, ঘরচিতি, লাউডগা, কাল নাগিনী ইত্যাদি সাপ সাবলীলভাবে ধরতে পারে তারা। সুরেলা গলায় গান গেয়ে সাপের খেলা দেখানো তাদের অন্যতম কাজ।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বেদের সর্দার আবেদ আলী জানান, দুই যুগেরও বেশি সময় আগে তারা বিক্রমপুর থেকে কাটাখালির এই সড়ক ও জনপদ বিভাগের  জমিতে বসবাস করছেন। বর্তমানে ৩০/৩৫টি পরিবার রয়েছে এখানে। যাদের মধ্যে ১২ জন ভোটার হয়েছেন।

তিনি বলেন, আমরা চাই সরকার আমাদের ভিটেমাটির ব্যবস্থা করে দেবে, স্বাভাবিক জীবন যাত্রার জন্য রাষ্ট্রের সব সুবিধা অন্যদের মতো আমাদেরও দেবে। আমরা অন্যান্য মানুষের মতো সভ্য সমাজে বাস করতে চাই, আমরা শিক্ষা চাই, চিকিৎসা চাই।

বেদে সম্প্রদায়ের দুঃখভরা জীবনের গল্প দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে এই প্রতিবেদককে আহ্বানও জানান আবেদ আলী।

বেদেপল্লীর পাশের গ্রাম নোয়াপাড়ার বাসিন্দা বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের ছাত্র ইমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘সংকট, হতাশা ও দুঃসংবাদের মধ্যে ‍সাধারণ মানুষের আলোর পথের যাত্রা থেমে নেই। যার উদাহরণ এই বেদেপল্লী। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকা এই পল্লীতে শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো আসতে শুরু করেছে। এখানে একটি স্কুল হয়েছে। যেখানে বেদে শিশুরা লেখাপড়া সুযোগ পাচ্ছে। ’

বেদে সম্প্রদায়ের আগের মতো কাজ না থাকায় আয় রোজগার কমে গেছে। এতে অপুষ্টি দেখা দিচ্ছে বেদে শিশুদের মধ্যে। এদের পুনর্বাসন ও সুন্দর জীবন দিতে সরকারের কাছে আহ্বানও জানান এই শিক্ষার্থী।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৬
এমআরএম/টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।