আমাদের এই সৌরজগতে পৃথিবীসহ অন্য গ্রহ ও গ্রহাণুপুঞ্জগুলো সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ঘুরছে। সৌরজগত একটি পরিবারের মতো।
আমরা জানি, মহাকাশে এমন অসংখ্য গ্যালাক্সি রয়েছে। আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করি, বাংলায় তাকে বলে আকাশগঙ্গা বা ছায়াপথ। আর ইংরেজীতে মিল্কিওয়ে।
এখন কথা হলো, আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রপুরুষ যেমন সূর্য, ঠিক তেমনই গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও রয়েছে এক মহাপুরুষ। তবে সেটি কোনো জীবিত তারকা নয়, মৃত তারকা বা কৃষ্ণগহ্বর।
কোনো তারকার শক্তি যখন ফুরিয়ে আসতে থাকে তখন এক পর্যায়ে তার অবশিষ্ট শক্তি নিয়ে তার ভেতরে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর তার ভেতর আলো ছড়ানোর জন্য যে শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়া চলছিলো, সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু সমস্যা হলো, জীবিত বা মৃত যেকোনো বস্তুই একে অপরকে আকর্ষণ করে। মহাকর্ষ সূত্রও তাই বলে। এজন্য সেই তারকার অবশিষ্ট অংশগুলো কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হতে থাকে। এতে তার মহাকর্ষ বল হতে থাকে আরও শক্তিশালী। এক পর্যায়ে এর মহাকর্ষ এতো শক্তিশালী হয় যে, আলো পর্যন্ত তার ভেতর থেকে বের হতে পারে না বা আশপাশের কোনো আলোও তার উপর পড়ে প্রতিফলিত হয়ে কোথাও যেতে পারে না। এই কৃষ্ণগহ্বর যে শুধু গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানেই থাকে তা নয় বরং মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই এমন মৃত তারকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
এর পর দেখা যায়, কৃষ্ণগহ্বরটি তার এই বিশাল আকর্ষণ বল দিয়ে আশপাশের ছড়িয়ে থাকা ধূলিকণা ও অন্য বস্তুগুলোকে গ্রাস করতে থাকে। আশপাশের সবকিছু এসে কৃষ্ণগহ্বরটির চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে একটি অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে। পদার্থ বিজ্ঞানে এই অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছে, ঘটনা দিগন্ত বা ইভেন্ট হরাইজন। এটি পদার্থ বিজ্ঞানের জগতে খুব বিষ্ময়কর একটি আবিষ্কার।
এক হিসেবে ইভেন্ট হরাইজন হলো, কৃষ্ণগহবরের একটি তাত্ত্বিক আবরণের মতো, যেখান থেকে কোনো প্রকার আলো বা বিকিরণ বের হতে পারে না। যখনই কোনো বস্তু এর প্রান্তের কাছে পৌঁছায়, তখন এর অণু-পরমাণু পর্যন্ত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি নিউক্লিয়াসের অস্তিত্বও বিলীন হয়ে যায়। অধিক হালকা ইলেক্ট্রনগুলো উচ্চ মাত্রার এই চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা আবিষ্ট হয়ে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিচ্ছিন্ন চলাচল শুরু করে। এর ভেতরে রয়েছে একরকম মোঁচড়ানো গতি। আর সেই গতিতে ফোটনগুলোও আলাদা হতে থাকে।
পদার্থ বিজ্ঞানের হিসেব অনুয়ায়ী, এমন শক্তিশালী মহাকর্ষীয় শক্তি সম্পন্ন কৃষ্ণগহবরের আশপাশে খুব শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র থাকার কথা। কথাটি এতোদিন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলেও, সম্প্রতি জ্যেতির্বিজ্ঞানীরা এর প্রমাণ পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে যে কৃষ্ণগহ্বরটি রয়েছে, তার ঠিক ইভেন্ট হরাইজনের বাইরে এমন একটি চৌম্বকক্ষেত্রেরই প্রমাণ পেয়েছেন। আর এ আবিষ্কার কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন পথ হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ভারী এ কৃষ্ণগহ্বরগুলো এক প্রকার ইঞ্জিনের মতো, যেখানে তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রটি জ্বালানির মতো কাজ করে। এখানে শক্তিকে বিকিরণে রূপান্তর করে জেট আকারে হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে পাঠানো হয়।
হার্ভার্ড স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স এর প্রধান কর্মকর্তা মাইকেল জনসন বলেন, এই চৌম্বকক্ষেত্রকে অনুধাবন করা এখনও আমাদের জন্য অনেক কঠিন কাজ। ইভেন্ট হরাইজনের কাছের এই চৌম্বকক্ষেত্রের ব্যাখ্যা এখনও পুরোপুরিভাবে দেওয়া সম্ভব হয়নি। চৌম্বকক্ষেত্রটি এতোদিন পর্যন্ত ছিলো একটি তাত্ত্বিক ধারণা। এর পর্যবেক্ষণলব্ধ প্রমাণ এতোদিন ছিলো না।
এমআইটির হেয়স্ট্যাক অবজাভেটরির প্রধাণ গবেষক শেপ ডোলেম্যান বলেন, দশকের পর দশক ধরে আমরা দৃঢ় পর্যবেক্ষণমূলক ভিত্তির উপর দাড়িয়ে এই তাত্ত্বিক গবেষণার উপাত্ত যুগিয়েছি।
এছাড়াও ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) নামে একটি রেডিওটেলিস্কোপের গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি একটি মহাজাগতিক দূরবীন আবিষ্কার করেছে।
আশা করা হচ্ছে, এতে ইএইচটি মহাকাশের ১৫ মাইক্রো আর্ক সেকেন্ড পর্যন্ত ক্ষুদ্র অঞ্চল এর পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে পারবে। (এক ডিগ্রির ৩৬০০ ভাগের এক ভাগ হলো এক মাইক্রো আর্ক সেকেন্ড)। আমাদের পৃথিবীর চারপাশের আকাশকে ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করা হয়েছে। ঠিক একটি বৃত্ত যেমন ৩৬০ ডিগ্রি। অর্থাৎ ১৫ মাইক্রো আর্ক সেকেন্ড হলো পুরো আকাশের ১,২৯,৬০০ ভাগের এক ভাগ। এটি কতোটা ক্ষুদ্র তা কল্পনা করা যথেষ্টই কঠিন। আর পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা এই পর্যায়ে আসা মানে হলো, পৃথিবীতে বসে চাঁদের বুকে একটি দেড় ইঞ্চি সাইজের টমেটো পর্যবেক্ষণের মতো।
আসলে কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার জন্য এমন উচ্চ বিবর্ধনের প্রয়োজন কারণ, এগুলোর আকৃতি মহাকাশের হিসেবে খুবই ক্ষুদ্র। যেমন, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ‘স্যাজিটেরিয়াস এ-স্টার’ নামে যে কৃষ্ণগহ্বরটি রয়েছে তার আকৃতি মাত্র এক কোটি ২০ লাখ কিলোমিটার, যা সূর্য থেকে বুধ গ্রহের দূরত্বেরও কম। তবে এই কৃষ্ণগহ্বরগুলোর মহাকর্ষ অনেক তীব্র হওয়ার কারণে এর ইভেন্ট হরাইজন যেভাবে আলোকে গ্রাস করে পরে নিঃসরিত করে, তাতে মহাশূন্যে একে অনেক বড়ই দেখায়।
সার্বিক পর্যবেক্ষণটি সম্পন্ন হয়েছে ১.৩ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের ব্যবধানে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আলোকের সুষম সমাবর্তনের হিসেব বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এতে দেখা গেছে, স্যাজিটেরিয়াস এ-স্টার নামে সেই কৃষ্ণগহ্বরের চৌম্বকক্ষেত্রের চারিদিকে ঘুর্ণায়মান ইলেক্ট্রন থেকে এই সমাবর্তিত আলো নিঃসরিত হয়। এর ফলে এ আলো থেকেই সরাসরি চৌম্বকক্ষেত্রের গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
কৃষ্ণগহ্বরটির চারপাশে রয়েছে নানা আকৃতির বস্তু যার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে ও তা কৃষ্ণগহ্বরটিকে প্রদক্ষিণ করছে। গবেষকরা আরও দেখেছেন, কৃষ্ণগহ্বরটির আশেপাশে আরও কিছু চৌম্বকক্ষেত্র বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। যা অনেকটাই একটি পিরিচের উপর কিছু নুডুলস যেমন পাকিয়ে থাকে তেমন দেখতে। অন্যান্য অঞ্চলের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো অনেক সুসংগত এবং সেখান থেকে জেট নিঃসরিত হয়। তারা আরো দেখেছেন যে চৌম্বক ক্ষেত্রটি ১৫ মিনিটের ব্যবধানে বেশ উঠানামা করে। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানীদের মন্তব্য হলো, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের অবস্থানটি আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশী গতিশীল। যেন সমস্ত স্থান জুড়েই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলো নাচানাচি করে বেড়াচ্ছে।
চৌম্বকক্ষেত্রটি আবিষ্কার হওয়ার পর কৃষ্ণগহ্বর কেন এতো উজ্জ্বল, এ প্রশ্নের উত্তরের অনেকটা কাছাকাছিই আমরা চলে এসেছি বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০০২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৫
এসএস