ঢাকা, রবিবার, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৮ মে ২০২৫, ২০ জিলকদ ১৪৪৬

ফিচার

অমর্ত্য সেনদের বাস্তুভিটা!

এস আহমেদ, জেলা সংবাদদাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:০৩, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১১
অমর্ত্য সেনদের বাস্তুভিটা!

মানিকগঞ্জ: ঐতিহ্যবাহী গ্রাম মত্ত। মানিকগঞ্জ পৌরসভার এ গ্রামেই শিকড় প্রথিত রয়েছে দেশ এবং জগৎখ্যাত বেশ ক’জন মানুষের।



মত্ত মঠের ক্ষয়িষ্ণু চূড়া নজর কাড়ে বহুদূর থেকেই। মঠের ঠিক পেছনে টলমলে জলের বিশাল দীঘি। দীঘির চারপাশ আগাছা আর জঙ্গলে ভরা। এর উঁচু দক্ষিণপাড় এখন পায়ে চলা পথ। সেখানে রিক্সাও চলে অনায়াসে।

এ পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে তাকালেই নজরে পড়ে জড়াগ্রস্ত বস্তির মত জড়াজড়ি করে থাকা ডজন দেড়েক টিনের ঘর আর ৮/৯ বছর বয়েসী সেগুন-মেহগনি’র বাগান। এখানেই এক সময় ছিল বিখ্যাত ‘জজবাড়ি’।

তবে জজবাড়ির একটি ইট-কাঠও আজ অবশিষ্ট নেই। হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। সবাই ভুলে গেছে জজ বাড়ির নাম। এ বাড়ির সন্তান বাঙালির গর্ব নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন।
 
১৯১৮ থেকে ১৯২০ এর মাঝামাঝি সময়ে সারদা প্রসাদ সেন বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন দেওয়ান বাহাদুর উপাধি। পেশায় ছিলেন সেশন জজ। তার ছোট ভাই অম্বিকা প্রসাদ সেনও ছিলেন সাব-জজ।

আর এ কারণে তাদের এ বাড়িটিকে সবাই ডাকতো জজবাড়ি বলে। সারদা প্রসাদের ছেলে বিলেতে পড়া আশুতোষ সেন শান্তি নিকেতনে গিয়েছিলেন ‘নটির পূজা’ নাটক দেখতে। নাটকের অভিনেত্রী অমিতাকে ভাল লেগে যায় তার। সিদ্ধান্ত নেন তাকেই জীবন সঙ্গী করবেন বলে।

বাবা অমত করেননি। সে সুবাদে অমিতাকে বিয়ে করে আশুতোষ সেন ফিরে আসেন মানিকগঞ্জের ওই মত্তগ্রামে। ‘নতুন বউ’কে দেখতে সেদিন পুরোগ্রাম ভেঙে পড়েছিল ‘জজবাড়ি’র উঠানে। এই আশুতোষ সেন আর অমিতা সেনের ঘরেই জন্ম নিয়েছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন।

সে সময়ের আলোচিত জজ বাড়িতে ছিল ৭/৮টি নকশাদার দৃষ্টিনন্দন টিনের ঘড়, নজরকাড়া পূজাম-প।
 
চাকরি সূত্রে জজবাড়ির দুই জজ ভাই বাইরে থাকলেও তাদের বাবা-মা স্থায়ীভাবেই থাকতেন এ বাড়িতে। আর অমর্ত্য সেন নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকার ওয়ারীর বাড়িতে বড় হয়েছেন। অমর্ত্য’র বাবা আশুতোষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। (দেশভাগের পরে আশুতোষ দিল্লিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। )

উৎসব, পূজা-পার্বণের ছুটি মিললেই একছুটে ঢাকা থেকে মত্তের বাড়িতে আসতে ভুলতেন না অমর্ত্যরে বাবা-মা। সঙ্গে আসতেন অমর্ত্য সেনও।

১৯৪৭ এর দেশভাগের ক’বছর আগে জজবাড়ির লোকেরা অনেক স্মৃতি, অনেক মায়া পিছনে ফেলে ভারতে চলে যান। এসব তথ্য বলবার মত বয়েসী মানুষ মত্ত গ্রামে আজ আর বলতে গেলে একজনও নেই।

যা বলবার তা বলছিলেন, এলাকার সর্বজন শ্রদ্ধেয় ৯০ পেরুনো সবারপ্রিয় মাস্টার মশাই। ৮৮’র বন্যার আগে, অমর্ত্যসেন যখন বিশ্বখ্যাতি পাননি তখন একবার হঠাৎ করেই নাড়ির টানে পূর্ব পূরুষের ভিটেমাটির স্পর্শ নিতে মত্ত গ্রামে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন পাশের বাড়ির চিরকুমার মাস্টার মশাই।

অমর্ত্য সেন সেদিন ঘুরে ঘুরে হেঁটেছেন যেখানে ছিল তার বসতবাড়ি, পুজাম-প, স্বপ্নময় উঠোন। পরম মমতায় হাত বুলিয়েছেন সেখানে বসবাসরত ইদ্রিস আলীর লাগানো লাউয়ের ডগায়।    

এক সময়ের আলোচিত জজবাড়ি এখন অর্পিত সম্পত্তি। একসনা লিজ নিয়ে তাতে বসত গেড়েছেন ইদ্রিসআলী, ময়জুদ্দিন, কছিমউদ্দিনের মত ৭/৮টি দরিদ্র ভূমিহীন পরিবার। পেশায় কেউ কৃষক, কেউবা ক্ষুদ্র দোকানি, কেউবা দিনমজুর। এদের অনেকেই জানেন না এ বাড়ির জজ সাহেবদের ইতিকথা। বোঝেন না নোবেল পুরস্কার, অর্থনীতি, আর জানেনও না অমর্ত্য সেনকে।

নিতান্ত অর্থনৈতিক বাস্তবতার খাতিরে, হতদরিদ্র এ মানুষগুলো এখন বিশ্বনন্দিত এক অর্থনীতিবিদের ছেড়ে যাওয়া বসতবাড়িতে বসবাস করছেন- এও এক অসাধারণ বাস্তবতা!

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।