পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার ৬ নম্বর দ্বারকানাথ সড়কে ঢুকতে একটি সুসজ্জিত গেট। বেশ মনোমুগ্ধকর কারুকাজে শোভিত।
১৭৩ শকাব্দের ১৬১ সালের ৭ মে, বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। বাঙালি তথা সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের কাছে এ বাড়িটি এখন একটি তীর্থ। জোড়াসাঁকোর এ গলিটির নাম ছিল মেছো কলোনি। কালের বিবর্তনে এটি এখন বিখ্যাত ৬ নম্বর দ্বারকানাথ লেন, যা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত।
বাড়ির ফটক ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে মনটা আপনিই বিচলিত হবে। চোখের সামনে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে থাকা একটি তিনতলা ভবন যেন আহ্বান করছে, ‘এসো, এসো আমার ঘরে...’। কিন্তু বাদ সাদে ওখানকার কর্তব্যরত মানুষরা। একটি গেটপাস না নিয়ে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না, যার দাম ১০ রুপি।
মূল ফটক থেকে ভেতরে ঢোকার রাস্তার ঠিক বাঁদিকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। কত মানুষের সমাগম। যেন মর্ত্যরে বাসিন্দা যত, খোঁজে সারা অমর্ত্যকে...। বিশ্বভারতীর সামনে একটি বড় চালতাগাছ দাঁড়িয়ে। তার ছায়ায় আশ্রিত কামিনীসহ নাম-না-জানা অনেক ফুল ও লতা। সবুজ গাছের ঝোঁপের আড়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে লাল দালান। এ বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ সংসার পেতেছিলেন।
ডান পাশে বাগান পেরিয়ে সারি সারি ঘর। এখানে বিশ্বভারতীর ক্লাস করানো হয়। প্রিন্স দ্বারকানাথের বিলাসবহুল বাড়ির গেটের দু পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মূর্তি। একপাশে রবীন্দ্রনাথের, অন্যপাশে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের।
বাঁদিকের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আগে পায়ের জুতা খুলতে ভুলবেন না। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে কানে ভেসে আসবে ক্ষীণ শব্দের রবীন্দ্রসঙ্গীত। সুরের এই মূর্ছনা আপনাকে নিয়ে যাবে সুরের দেশে। এ বাড়ির বাতাসে যেন সারাক্ষণ সুর আর কথার খেলা চলে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় একটি কথা বার বার মনের মধ্যে প্রশ্ন হয়ে ঘুরপাক খায়। বিরাট বাড়ি কিন্তু তার সিঁড়িগুলো এত ছোট যে দুজন মানুুষ পাশাপাশি উঠতে বা ওঠানামা করতে পারবে না। সিঁড়িগুলো লাল কার্পেটে মোড়া, হাঁটার সময় নিজেকে বেশ সুখী সুখী মনে হয়। এর অবশ্য একটা কারণ আছে, এ বাড়িতে ঢোকার পর কেবলই মনে হতে থাকে, এ বাড়ির মাটিতে একসময় রবীন্দ্রনাথ হেঁটেছেন, খেলা করেছেন, লিখেছেন, গেয়েছেন...। আজ এত বছর পর এই মাটি স্পর্শ করছে নতুন প্রজন্ম। এটা কি কম কথা? মনে হতে পারে, এ বাড়ির এখানে-সেখানে এখনো যেন তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
ডান পাশের লালবাড়িটির দোতলার চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকতেই রবীন্দ্রনাথের বসার ঘর। একটি টি-টেবিল ঘিরে তিনটি আরাম কেদারা বিছানো। যেটিতে কবি বসতেন সেটি সুসজ্জিত। মনের অজান্তে স্পর্শ করতেই, মনের মধ্যে গেয়ে উঠবে, একদিন এইখানে বসে তুমি লিখেছিলে যে কথা, পেয়েছি পেয়েছি সে বারতা...।
এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলে বিরাট এক ঘর। এখানেই আলমারি দিয়ে পার্টিশন করে তিনটি ঘর করা হয়েছিল। মৃণালিনী দেবীর শেষ শয্যাও এখানেই পাতা হয়েছিল। সারারাত মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুশয্যা পাহারা দেওয়ার পর কবি চলে গিয়েছিলেন ছাদে। এ ঘরটির ঠিক পেছনে রয়েছে খুব সাদামাটা একটা রুম। উত্তরপাশ জুড়ে খোলা জানালা। পশ্চিমে একটি বেলজিয়াম আয়নার ড্রেসিং টেবিল। একটি শেলফে এখনো সাজানো আছে রুপার বাক্স, রবীন্দ্রনাথের রুপার গ্লাস এবং কয়েকটি বিলেতি শোপিস। এগুলো রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে আসার সময় সঙ্গে করে এনেছিলেন। রুমটির একটি দেয়ালে মৃণালিনীর একটি বড় ছবি বাঁধানো। তার নিচে মৃণালিনীর নিজের হাতে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠি। অন্য দেয়ালে কবির নিজের হাতে লেখা নিজের বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র। এ ঘরে প্রতি রাতে বা দিনে কবির সাথে কবিপতœীর প্রেম-প্রণয় বা মান-অভিমান খেলা চলত। সামনে বড় বারান্দা। এ বারান্দাতেই মৃণালিনী দেবী ভাসুরপো বলেন্দ্রনাথের কাছে সাহিত্য পড়া শুনতেন।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটু ঘুরে অপর পাশ দিয়ে অন্য সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয় আরেক দালানে। এখানে প্রথম ঘরটিতে রয়েছে কবির ব্যবহৃত পোশাক। একটি বড় আয়না। কবি যতবার পারিবারিক নাটক করেছেন, এই ঘরে এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছেন। বারান্দা ঘুরে অন্য ঘরে গেলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হবে। এখানেই কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। দেয়ালে টাঙানো কয়েকটি ছবি, যা তাঁর রোগশয্যার চিহ্নমাত্র। এর পেছনের ঘরটিতে পর্দা টেনে কবির শেষ অপারেশন করানো হয়েছিল।
আরো সামনের ঘরটি কবির লেখার ঘর। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এখানে এসে মজলিস বসাতেন। কবি থাকতেন মধ্যমণি। অতিথিদের সঙ্গে খোশগল্প করতে কবি খুব পছন্দ করতেন। ঘোরানো বাড়ির মাঝে উঠোন রয়েছে উদোম। ফাঁকা উঠানের দিকে তাকালে মনে হয় এই বুঝি দাস-দাসীদের নজরে পড়বে। চারপাশে ঘোরানো বারান্দা। বারান্দা ধরে অনায়াসে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি চলে যাওয়া যায়। এক-একটি বাড়িতে রয়েছে অনেকগুলি ঘর। প্রত্যেকটি ঘর বেশ প্রশস্ত। দেয়ালে টাঙানো স্মৃতিচিহ্ন ছবি শোভা পাচ্ছে। প্রত্যেক ঘরে রয়েছে ঠাকুরবাড়ির ব্যবহৃত সে সময়কার অনেক অনেক স্মৃতি। কোলকাতা মিউনিসিপালিটির দেওয়া একটি বিরাটাকার ব্রাভিয়া টেলিভিশন রাখা আছে। এখানে দেখানো হয় ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য ও কয়েক পুরুষের তোলা ছবি; বিশেষ বিশেষ ঘরের ছবি ও ব্যবহৃত তৈজসপত্র। এছাড়া একটি ঘরের দেয়ালজুড়ে বড় বড় ছবি বাঁধানো রয়েছে। এখানে পর্যায়ক্রমে প্রিন্স দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি পর্যন্ত রয়েছে।
সামনের বারান্দায় একটি বিশেষ টেবিলে কাচে ঘেরা রয়েছে একটি ট্রেনের রেপ্লিকা। শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যে ট্রেনে করে কবি জোড়াসাঁকো এসেছিলেন, সে ট্রেনটির একটি রেপ্লিকা তৈরি করে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে উপহার দিয়েছে।
একটি ছোট্ট সিঁড়ি ডিঙিয়ে যেতে হয় অন্য বাড়িতে। এখানকার ঘরগুলো সব হিজিবিজিভাবে বিন্যস্ত। কোনো কোনো ঘরে চাকর-বাকররা থাকতেন। কোনো কোনো ঘরে গল্পের মজলিস বসত। কোথাও রয়েছে বুদ্ধদেবের মূর্তি। তিব্বত থেকে কবিকে দেওয়া নানা উপহার সামগ্রী। চীনা বন্ধুদের সাথে তোলা কবির অনেক ছবি। কখনো লাঠিয়ালবেশে, কখনো হাতির পিঠে, কখনো বক্সার রবীন্দ্রনাথ এবং শিকাগোর কবিদের সাথে তোলা বিভিন্ন পোজের ছবি।
জানা যায়, জাপানি নামিদামী ব্যক্তিদের উপস্থিতি উপলক্ষে ঠাকুরবাড়িতে প্রথম চা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সে উপলক্ষে বিশেষ আকৃতির চায়ের সরঞ্জাম তৈরি করা হয়েছিল। কাঠের চুলার পরিবর্তে দোতলাতেই কয়লার চুল্লির বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সে স্মৃতি ধরে রাখতে এখনো সেখানে কৃত্রিম কয়লার আগুন, কেতলি ও কাঠের তৈরি চামচ আর কয়েকটি মগ রাখা আছে। যে বিছানায় বসে তারা সময় কাটিয়েছিলেন সেটি সংরক্ষিত করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থায়। কবির সাথে তোলা সেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি এখনো সে বিছানায় শোভা পাচ্ছে।
বাড়ির আয়তন ও কক্ষ দেখে অনায়াসে অনুমান করা যায় এ বড়িতে শ খানেক লোকেরও বেশি মানুষ বাস করতেন। বাড়ির ছাদগুলো এমনভাবে করা যেন দোতলার মানুষও ছাদের স্বাদ পান।
কবির লেখায় বা কবি-সম্পর্কিত লেখায় বার বার এই ছাদের কথা চলে এসেছে। সত্যি ছাদ যেন মনের বাড়ি। এই ছাদে অনুষ্ঠিত হয়েছে সখী সমিতি। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রাণী’ নাটকের মঞ্চায়নও হয়েছে এই ছাদে। এ ছাদ ঘিরে বাংলা সাহিত্যে অনেক কথা অনেক গল্পের জন্ম হয়েছে। তাই হয়তো এ ছাদের একটা বিশেষত্ব রয়ে গেছে বাঙালির হৃদয়ে।
সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠলে চোখে পড়বে একটি কক্ষ। খুব বড় নয়। এখানে প্রিন্স দ্বারকানাথের ছবি বাঁধানো আছে। এছাড়া আছে কিছু বইপত্র ও শাস্ত্রীয় বই। এ ঘরটিতে কবিমাতা সারদাদেবী তাসের আসর জমাতেন সখীদের সাথে। কখনো কখনো দাসীদের সাহায্যে শরীরের ব্যায়াম করাতেন।
এ ঘরটির ভেতর দিয়ে একটি দরজা রয়েছে। তার ওপারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কক্ষ। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’য় পাওয়া যায়, তিনতলায় বাবার ঘরে ঢুকে তিনি দরজা বন্ধ করে সময় কাটাতেন। এখানে দেবেন্দ্রনাথের কক্ষে এখনো শোভা পাচ্ছে কুচকুচে কালো একটি মজবুত খাট। খুব জমকালো না হলেও দেখলে মনে হয় আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে। পাশে শেলফে রাখা আছে জমিদারির কিছু নথিপত্র, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এছাড়া শাস্ত্রীয় বই রাখা আছে। আছে দুটি বিশেষ ধরনের জলচৌকি। একটিতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বসতেন, অন্যটি সামনে থাকত। এখানে বসেই তিনি উপাসনা করতেন। কখনো কখনো শাস্ত্রপাঠ করতেন।
তিনতলা থেকে সোজা নেমে জুতা সংগ্রহ করে আবার যেতে হবে অভ্যর্থনাকক্ষে। সেখানে রক্ষিত ক্যামেরা, বা যাবতীয় জিনিস সংগ্রহ করে বের হতে হবে। বাগানের উঠোনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে করলে ছবি তোলা যাবে। সোজা পথ ধরে হাঁটতে থাকলে হাতের বাঁদিকে চোখে পড়বে একটি গ্যারেজ। এখানে একটি গাড়ি রাখা আছে কালো রঙের। এটি মূলত রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত গাড়ি। এটি এখন বিশ্রামে আছে। এর যাত্রী ছুটি নেবার পর এটিও ছুটি পেয়েছে অনন্তকালের। আর সাক্ষী হয়ে আছে একটি অধ্যায়, একটি কালের।
বাংলাদেশ সময় ২২৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১১